
সাদত হোসেন মান্টো : জীবন ও সাহিত্যকর্ম
(Saadat Hasan Manto: জীবন ও সাহিত্যকর্ম)
🔷 পরিচিতি
সাদত হোসেন মান্টো (Saadat Hasan Manto) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর সাহসী ও সত্যনিষ্ঠ লেখনী উপমহাদেশের বিভাজন, যৌনতা, সামাজিক ভণ্ডামি ও মানবতার নির্মম চিত্র তুলে ধরেছে। বিশেষ করে, ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময়কার বিভীষিকা তাঁর সাহিত্যকর্মে তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
🔷 জন্ম ও শৈশব
সাদত হোসেন মান্টোর জন্ম ১১ মে ১৯১২ সালে, ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানা জেলার সামরালা শহরে।
তাঁর পরিবার ছিল কাশ্মীরি মুসলিম। পিতা ছিলেন একজন কঠোর বিচারক, যা মান্টোর স্বাধীনচেতা মানসিকতার সঙ্গে অনেক সময় সাংঘর্ষিক ছিল।
🔷 শিক্ষাজীবন
মান্টো আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ভিক্টর হুগো, রুশো, চেখভ, গোরকী ও দস্তয়েভস্কির লেখা পড়ে প্রভাবিত হন।
তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় অনুবাদ দিয়ে। তিনি ভিক্টর হুগোর “The Last Day of a Condemned Man” অনুবাদ করেন উর্দুতে Sarguzasht-e-Aseer নামে।
🔷 সাহিত্যজীবনের সূচনা
১৯৩৩ সালে লাহোরের একটি পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প “Tamasha” প্রকাশিত হয়, যা ছিল ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড অবলম্বনে লেখা।
এরপর তিনি বম্বে (মুম্বাই) চলে যান এবং চলচ্চিত্র জগতে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রখ্যাত অভিনেতা অশোক কুমারের সঙ্গে একাধিক ছবির চিত্রনাট্য লেখেন।
🔷 বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম
মান্টো মূলত ছোটগল্প লেখক হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর গল্পে মানবিকতা, যৌনতা, পাগলামি, দাঙ্গা, দরিদ্রতা এবং বাস্তবতাকে নির্মম অথচ সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা হয়।
🖋️ উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প:
- ঠাণ্ডা গোশত (Thanda Gosht)
- টোবা টেক সিং (Toba Tek Singh)
- বু (Bu)
- খোল দো (Khol Do)
- কালি শালওয়ার (Kaali Shalwar)
- হাতক (Hatak)
- মোজেল (Mozel)
- ধুয়া (Dhuaan)
📘 প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীমূলক রচনা:
- Letters to Uncle Sam
- Manto ke Mazameen
- Manto: My Name is by Saadat Hasan Manto (আত্মজৈবনিক)
🔷 ভাষা ও শৈলী
মান্টোর লেখায় ছিল অকপটতা, তীব্র বাস্তবচিত্র ও সাহসী ভাষা।
তাঁর সাহিত্যে নগ্নতা নয়, বরং সমাজের ন্যাংটো বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলতেন —
❝ If you cannot bear these stories, it is because we live in unbearable times. ❞
🔷 দেশভাগ ও পাকিস্তানে গমন
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মান্টো পাকিস্তানে চলে যান এবং লাহোরে বসবাস শুরু করেন।
তবে তিনি মানসিকভাবে দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি, এবং তাঁর বহু গল্পে এই বেদনার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় – বিশেষ করে “টোবা টেক সিং” গল্পে।
🔷 বিতর্ক ও মামলা
তাঁর সাহিত্যে যৌনতা ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রকাশের জন্য তাঁকে প্রায়শই অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানে একাধিক মামলা হয়েছিল।
🔷 মৃত্যু
অসামাজিকতা, বিষণ্নতা ও মদ্যপানজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মান্টো মৃত্যুবরণ করেন ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে, মাত্র ৪২ বছর বয়সে।
মৃত্যুর আগে তিনি নিজের জন্য এই শিলালিপি লিখেছিলেন—
“Here lies Saadat Hasan Manto, in whose breast were enshrined all the secrets and mysteries of the art of storytelling.”
🔷 মান্টো ও উত্তরাধিকার
মান্টো এখন উর্দু সাহিত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
২০০৫ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে পোস্টহিউমাসভাবে ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ প্রদান করে।
২০১৮ সালে বলিউডে “Manto” নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যেখানে মান্টোর চরিত্রে অভিনয় করেন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি।
🔷 উপসংহার
সাদত হোসেন মান্টো এক সাহসী কলমযোদ্ধা, যিনি কোনো মুখোশ পরেননি—লিখেছেন যা সত্য, তুলে ধরেছেন যা গোপন, প্রকাশ করেছেন যা অনুচ্চারিত।
তাঁর সাহিত্যে যেমন বিদ্রোহ আছে, তেমনি আছে গভীর মানবতা ও করুণা।
তিনি যেন সাহিত্যের আয়নায় সমাজের মুখ দেখিয়ে গেছেন—নগ্ন, নির্মম, অথচ সত্য।