ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ – উদ্ভব ও গুরুত্ব

Spread the love

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ – উদ্ভব ও গুরুত্ব

১. ভূমিকা

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছিল ভারতের উপমহাদেশে ইংরেজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিক বিকাশে বিশাল অবদান রেখেছে। এটি শুধু একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রই ছিল না, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করে, যা বাংলা ভাষাকে আধুনিকতা, গদ্যরীতি ও সাহিত্যিক পরিসরে নিয়ে আসে।

২. প্রতিষ্ঠা ও উদ্দেশ্য

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০০ সালের ১০ জুলাই, তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড রিচার্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে আসা ইংরেজ নবীন কর্মচারীদের স্থানীয় ভাষা, আইন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যাতে তারা দক্ষ প্রশাসক হয়ে উঠতে পারে।

ওয়েলেসলি বুঝেছিলেন, স্থানীয় ভাষা না জানলে ভারত শাসন কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এজন্য কলেজে বিভিন্ন ভাষা বিভাগ খোলা হয় এবং স্থানীয় পণ্ডিতদের যুক্ত করা হয়। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে ‘ভারতের অক্সফোর্ড’ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

৩. ভাষা বিভাগ

কলেজের প্রধান ভাষা বিভাগগুলো ছিল—

  • বাংলা
  • হিন্দুস্তানি
  • ফার্সি
  • আরবি
  • সংস্কৃত

এই বিভাগগুলোতে দক্ষ শিক্ষক ও পণ্ডিত নিয়োগ করা হয়। বাংলা বিভাগের তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিশনারি উইলিয়াম কেরি। স্থানীয় পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন রামরাম বসু, মন্নমোহন বিদ্যলঙ্কার, গোবিন্দরাম শর্মা প্রমুখ।

৪. শিক্ষাদান ও অনুবাদ কার্যক্রম

কলেজের অন্যতম কাজ ছিল ইউরোপীয় সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থ বাংলা, ফার্সি, হিন্দুস্তানি ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করা। সেইসঙ্গে এসব ভাষায় ব্যাকরণ, অভিধান ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা।

বাংলা গদ্য সাহিত্যের আধুনিক বিকাশ এই অনুবাদ কার্যক্রম থেকেই শুরু হয়। এ সময়ে বাংলা ভাষায় যেসব গ্রন্থ অনুবাদ ও রচিত হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • হিতোপদেশ
  • ঈশপের নীতিকথা
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি
  • সিংহাসন বত্তিসী
  • পতিত পাবন
  • রাজাবলী
  • ইতিহাসমালা

৫. বাংলা গদ্য ও সাহিত্যে অবদান

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে বাংলা গদ্যের জন্মভূমি বলা হয়। কারণ, এ কলেজ থেকেই আধুনিক বাংলা গদ্যের সূচনা হয়। আগে বাংলা সাহিত্য মূলত পদ্য বা কবিতানির্ভর ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা প্রথম ধারাবাহিক ও প্রাঞ্জল গদ্য রচনায় মনোনিবেশ করেন।

এই গদ্যরীতি ছিল সহজবোধ্য, প্রমিত এবং পাঠযোগ্য। পরবর্তীতে বাংলা উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ইতিহাস রচনার ভিত্তি এই গদ্যভাষার ওপর নির্মিত হয়।

৬. বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণ রচনা

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকেই বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান রচনার সূচনা হয়। উইলিয়াম কেরি ও রামরাম বসু বাংলা ভাষার প্রথম প্রাথমিক ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন। উইলিয়াম কেরির লেখা “A Grammar of the Bengali Language” (১৮০১) বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।

এছাড়া “A Dictionary of the Bengali Language” শীর্ষক অভিধান প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তী বাংলা অভিধান রচনার ভিত্তি স্থাপন করে।

৭. মুদ্রণযন্ত্র ও গ্রন্থপ্রকাশ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা ও অন্যান্য ভাষার বই প্রকাশে মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার শুরু করে। এ কলেজে স্থাপিত হয় পৃথক ছাপাখানা, যার মাধ্যমে প্রায় দুই লাখ কপি বই বিভিন্ন ভাষায় মুদ্রিত হয়।

এই প্রক্রিয়ায় সাহিত্য সহজলভ্য হয় এবং পাঠকের বিস্তার ঘটে। সেজন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে বাংলা ছাপা সাহিত্যের বিকাশেও পথপ্রদর্শক বলা যায়।

৮. বিশিষ্ট পণ্ডিত ও তাঁদের অবদান

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • রামরাম বসু – রাজাবলী, মহাভারতের অনুবাদ, সহজ ভাষায় ইতিহাস রচনা
  • মন্নমোহন বিদ্যলঙ্কার – হিতোপদেশ ও সংস্কৃত কাহিনি অনুবাদ
  • গোবিন্দরাম শর্মা – কাব্য ও ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ
  • উইলিয়াম কেরি – ব্যাকরণ ও অভিধান রচনায় অগ্রণী
  • জন গিলক্রিস্ট – হিন্দুস্তানি ভাষা শিক্ষা ও অভিধান প্রণেতা

৯. সাহিত্যিক পুনর্জাগরণ ও আধুনিকতা

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ গঠনে মূল সহায়ক হয়। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে—

  • ভাষা ও সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষতা আসে
  • প্রশাসনিক ভাষার আধুনিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়
  • শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা পরবর্তীতে রেনেসাঁসের ধারক হয়

এই প্রতিষ্ঠানের ভাষানীতি ও শিক্ষাদান বাংলার নবজাগরণের ভিত্তি স্থাপন করে।

১০.সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবজাগরণ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্য, ব্যাকরণ, অভিধান, অনুবাদ সাহিত্যের নতুন যাত্রা শুরু হয়। সাহিত্যচর্চা, ভাষা উন্নয়ন ও মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার—এই তিনটি ক্ষেত্রেই কলেজের অবদান অনস্বীকার্য।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ শুধু ইংরেজ প্রশাসকদের ভাষা শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না, বরং এটি ছিল ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবজাগরণের অন্যতম সূতিকাগার।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ – উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন 

১১. কলেজের বিলুপ্তি

১৮৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে বলা যায়:

  • ব্রিটিশ সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে ইংল্যান্ডমুখী করতে চেয়েছিল।
  • ম্যাকলে মিনিট (১৮৩৫) অনুসারে, ইংরেজি শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
  • প্রশাসনের নতুন কর্মচারীদের ইংল্যান্ডেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ফলে ধীরে ধীরে কলেজটির গুরুত্ব কমে আসে এবং এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। তবে এর কার্যক্রম যেমন অনুবাদ, ব্যাকরণ, সাহিত্যরচনা ইতিমধ্যেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভিত মজবুত করে ফেলেছিল।

১২. হেলিবেরি কলেজ ও প্রশিক্ষণ পরিবর্তন

১৮০৫ সালে ইংল্যান্ডে হেলিবেরি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মূল আদর্শে গঠিত হলেও, এটি ছিল শুধুই ইংরেজ ছাত্রদের জন্য। সেখানে ইংরেজ ভাষায় শিক্ষাদান হতো এবং স্থানীয় ভাষা শেখার গুরুত্ব কমতে থাকে।

ফলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ঐতিহাসিক ভূমিকা ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে অনেকটাই গৌণ হয়ে পড়ে।

১৩. সেরাম্পুর মিশন ও ভাষাচর্চায় প্রভাব

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বন্ধ হওয়ার পরেও এর আদর্শ সেরাম্পুর মিশনের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড-এর নেতৃত্বে মুদ্রণ, অনুবাদ ও শিক্ষাকর্ম অব্যাহত থাকে।

এই ধারায় অনেক শিক্ষিত বাঙালি জন্ম নেন, যাঁরা পরবর্তীকালে নবজাগরণের মুখ্য পথিকৃৎ হন।

১৪. বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভিত্তি

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা গদ্যের যে ভিত্তি স্থাপন করেছিল, তা পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের সব শাখাকে প্রভাবিত করে:

  • উপন্যাস: বাংলা গদ্যের শৈলীতে অনুবাদের যে সরলতা আনা হয়, তা উপন্যাস রচনায় সহায়ক হয়। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের গদ্যে এ প্রভাব লক্ষণীয়।
  • প্রবন্ধ ও ইতিহাস: তথ্যভিত্তিক রচনায় গদ্যের শৃঙ্খলা ও যুক্তিপূর্ণতা আসে।
  • নাটক ও অনুবাদ: বাংলা নাটকের রচনাশৈলী গড়ে ওঠে কলেজের অনুবাদভাষার ধারায়।

১৫. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রভাবে তৈরি হয় এক নতুন শ্রেণি – শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি। তাঁরা ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় দক্ষ ছিলেন এবং সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, সমাজসংস্কারে, রাজনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করেন।

এই শ্রেণির হাত ধরেই বাংলায় আধুনিক জাতীয়তাবাদের বীজ বপন হয়।

১৬. নবজাগরণে প্রভাব

বাংলা নবজাগরণের সূচনা হয় মূলত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহিত্য ও ভাষা সংস্কারের মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠান:

  • ভাষার আধুনিকতা আনে
  • বাঙালিকে নিজেদের ভাষায় সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে
  • শিক্ষার গুরুত্ব বোঝায়

এই সংস্কারের ধারায় গড়ে ওঠেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ।

১৭. মূল্যায়ন

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানকে নীচের কয়েকটি দিক থেকে মূল্যায়ন করা যায়:

ক. ভাষা ও সাহিত্য:
বাংলা ভাষাকে গদ্যের মাধ্যমে প্রাঞ্জল, প্রমিত ও কার্যকর যোগাযোগের ভাষায় পরিণত করে।

খ. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:
ভারতীয় প্রশাসনে কাজ করা ইংরেজ কর্মকর্তাদের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি শেখার সুযোগ দেয়।

গ. সাহিত্য চর্চা:
অনুবাদ সাহিত্য ও ব্যাকরণ রচনার মাধ্যমে নতুন সাহিত্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।

ঘ. মুদ্রণ ও গ্রন্থ প্রকাশ:
বাংলা বইয়ের ব্যাপক মুদ্রণ এবং সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে।

ঙ. নবজাগরণ ও জাতীয় চেতনা:
এ প্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু হয় শিক্ষিত বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান।

১৮. সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদানকে ভাষা ও শিক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব, অনুবাদ সাহিত্য, ও প্রমিত বাংলা গদ্যের মানদণ্ড—সবই এরই ধারাবাহিকতা।

বিশ্বায়নের যুগে মাতৃভাষার উন্নয়ন ও শিক্ষায় এর আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক।

১৯. উপসংহার

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর নাম। যদিও এটি একটি ইংরেজদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান ছিল, তবে এর কার্যক্রম বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এক গৌরবময় পরিবর্তন এনে দেয়।

বাংলা গদ্যের ভিত্তি, অনুবাদ সাহিত্য, ব্যাকরণ ও অভিধান নির্মাণ, মুদ্রণযন্ত্রে বই প্রকাশ এবং সাহিত্য-সচেতন মধ্যবিত্তের সৃষ্টি—সব মিলিয়ে এটি বাংলার নবজাগরণের অনুঘটক।

বর্তমান বাংলা সাহিত্য ও ভাষার উত্থানে এই কলেজের অবদান অপরিসীম ও স্মরণীয়। তাই, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলা জাতিসত্তার এক মহান প্রেরণাসূত্র।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ – উদ্ভব ও গুরুত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *