নীলস বোর : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ
ভূমিকা
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে যাঁরা মৌলিক পরিবর্তন এনেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন নীলস হেনরিক ডেভিড বোর (Niels Henrik David Bohr)। তিনি ছিলেন ড্যানিশ পদার্থবিদ, যিনি পারমাণবিক গঠন ও কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিপ্লব ঘটান। বোর মডেল আজও পারমাণবিক তত্ত্ব শেখার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
নীলস বোর জন্মগ্রহণ করেন ৭ অক্টোবর ১৮৮৫ সালে, কোপেনহেগেন, ডেনমার্কে। তাঁর পিতামাতা ছিলেন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা।
- পিতা: ক্রিস্টিয়ান বোর, একজন বিশিষ্ট ফিজিওলজিস্ট
- মাতা: এলেন অ্যাডলার, একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত শিক্ষিত নারী
- ছোট ভাই হ্যারল্ড বোর ছিলেন একজন প্রখ্যাত গণিতবিদ
শিক্ষাজীবন ও প্রারম্ভিক গবেষণা
বোর কিশোর বয়স থেকেই বিজ্ঞানে আগ্রহী ছিলেন। তিনি কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১১ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
● গবেষণার প্রাথমিক ক্ষেত্র:
- ধাতব গঠনের ইলাস্টিসিটি
- ক্যাথোড রশ্মি ও তড়িৎচৌম্বক তত্ত্ব
- থমসনের ইলেকট্রন তত্ত্ব বিশ্লেষণ
রাদারফোর্ডের তত্ত্ব এবং বোরের সংশোধন
বোরের বৈজ্ঞানিক জীবন নতুন গতি পায় যখন তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং আর্নেস্ট রাদারফোর্ড-এর গবেষণাগারে কাজ করেন।
রাদারফোর্ড পারমাণবিক গঠনের একটি মডেল দিয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল স্থিতিশীলতার দিক থেকে অসম্পূর্ণ। বোর সেটিকে কোয়ান্টাম ধারণার মাধ্যমে সংশোধন করেন।
বোরের পরমাণু মডেল (1913)
নীলস বোর প্রথম ব্যাখ্যা করেন:
● প্রধান ধারণাসমূহ:
- ইলেকট্রন পরমাণুর কেন্দ্রে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে
- ইলেকট্রন কক্ষপথ পরিবর্তন করলে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা নির্গত করে
- এই নির্গত বা শোষিত শক্তি হয় নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (quanta)
📌 এই তত্ত্বের মাধ্যমে হাইড্রোজেন পরমাণুর রৈখিক বর্ণালির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে বোরের প্রভাব
বোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক অনন্য ব্যাখ্যাদাতা।
● Complementarity Principle:
তিনি বলেন, আলো বা কণিকা একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আচরণ করতে পারে, নির্ভর করে পরীক্ষার পদ্ধতির ওপর।
এটি আধুনিক কোয়ান্টাম দর্শনের এক ভিত্তি।
নোবেল পুরস্কার অর্জন
১৯২২ সালে, নীলস বোর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
- কারণ: “At the investigation of the structure of atoms and of the radiation emanating from them”
- এটি ছিল পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে এক মাইলফলক স্বীকৃতি
কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (Copenhagen Interpretation)
নীলস বোর ও তাঁর ছাত্র ভেরনার হেইজেনবার্গ মিলে কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করান, যাকে বলা হয় “Copenhagen Interpretation”।
● এর মূল ধারণা:
- পরমাণুর কণিকা যেমন ইলেকট্রন একসঙ্গে কণা ও তরঙ্গ—উভয় রূপ ধারণ করতে পারে
- কণিকার অবস্থা নির্ধারিত হয় পর্যবেক্ষণ বা মাপজোখের মাধ্যমে
- অবজারভেশন না করলে কণিকার অবস্থা অস্পষ্ট বা সম্ভাব্য রূপে থাকে
📌 এটি কোয়ান্টাম তত্ত্বে দর্শন ও পদার্থবিদ্যার মেলবন্ধন ঘটায়।
কোয়ান্টাম বিতর্ক : আইনস্টাইন বনাম বোর
বোর ও আইনস্টাইনের মধ্যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে এক ঐতিহাসিক বিতর্ক গড়ে ওঠে। আইনস্টাইন বলতেন—
“God does not play dice.”
বোর উত্তর দেন—
“Stop telling God what to do.”
এই বিতর্কে বোর বলেন, প্রকৃতির আচরণ সম্ভাব্যতাভিত্তিক হলেও সেটি বিজ্ঞানের পরিপন্থী নয়।
সমাজ ও রাজনীতিতে বোরের ভূমিকা
● দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়:
- বোর নাৎসি জার্মানি থেকে ইহুদি বিজ্ঞানীদের পালাতে সহায়তা করেন
- নিজে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান এবং ম্যানহাটন প্রকল্প-এ (পারমাণবিক বোমা নির্মাণ প্রকল্প) সহযোগিতা করেন
● শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য:
বোর পারমাণবিক শক্তিকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন।
তিনি পরমাণু যুদ্ধ প্রতিরোধে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে উন্মুক্ত সংলাপের আহ্বান জানান।
বোর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান
বোর “ইনস্টিটিউট ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স” (বর্তমানে Niels Bohr Institute) প্রতিষ্ঠা করেন। এটি:
- কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখে
- বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে
মৃত্যুবরণ
নীলস বোর মৃত্যুবরণ করেন ১৮ নভেম্বর ১৯৬২, ৭৭ বছর বয়সে।
তিনি প্রয়াত হন কোপেনহেগেনে, নিজ দেশের মাটিতে, বিজ্ঞান ও মানবতার এক মহান শিক্ষক হিসেবে।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
নীলস বোর ছিলেন কেবল একজন বিজ্ঞানী নন, ছিলেন একজন দার্শনিক, শিক্ষাগুরু ও শান্তিকামী মানুষ।
● বৈজ্ঞানিক প্রভাব:
শাখা | প্রভাব |
---|---|
পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান | বোর মডেল, কোয়ান্টাম স্তর |
কোয়ান্টাম মেকানিক্স | পরিপূরকতা নীতি, কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা |
শিক্ষা | থিওরিটিকাল ফিজিক্স চর্চার ভিত্তি |
দর্শন | বিজ্ঞানের সীমা ও ব্যাখ্যার নতুন মানদণ্ড |
● সম্মাননা ও স্মরণ:
- ডেনমার্কের মুদ্রায় নীলস বোরের ছবি
- “Bohr radius”, “Bohr magneton” পদার্থবিদ্যায় একক হিসেবে ব্যবহৃত
- তাঁর ছেলে আজে বোর-ও পরবর্তীতে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী হন
উপসংহার
নীলস বোর ছিলেন বিজ্ঞানের এমন এক পথিকৃৎ, যিনি পারমাণবিক জগতকে শুধু ব্যাখ্যা করেননি—তাঁর তত্ত্ব ও চিন্তা আজও বিজ্ঞানের সবচেয়ে গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে সাহায্য করে।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন—
“যা নিরবধি মনে হয়, তা-ও অনিশ্চিত হতে পারে, যদি আমরা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করি।”
বোরের জীবন ও কর্ম আজও বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা দেয় যুক্তি, অনুসন্ধান ও মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য।