গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ
ভূমিকা
আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করা ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম হলেন গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (Gregor Johann Mendel)। তাঁকে বলা হয় “জিনতত্ত্বের জনক (Father of Genetics)”। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী গবেষণা ও যুক্তিবোধের মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে বৈশিষ্ট্য কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যায়—তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করেন তিনিই সর্বপ্রথম।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
গ্রেগর মেন্ডেল জন্মগ্রহণ করেন ২০ জুলাই ১৮২২ সালে, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র) হেইনজেনডর্ফ নামক গ্রামে।
- আসল নাম: যোহান মেন্ডেল
- পিতার নাম: অ্যান্তোন মেন্ডেল (একজন কৃষক)
- মায়ের নাম: রোজিনা
- শৈশব থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল
● শিক্ষাজীবন:
তিনি স্থানীয় স্কুল শেষ করে অলমুটজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে যান Augustinian Abbey of St. Thomas, যেখানে সন্ন্যাসী হিসেবে নাম গ্রহণ করেন: Gregor।
ধর্মীয় জীবন ও বৈজ্ঞানিক চর্চা
মেন্ডেল ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান সন্ন্যাসী, কিন্তু ধর্মীয় পরিবেশও তাঁকে বিজ্ঞানচর্চা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তাঁর ধর্মগুরুদের অনেকেই বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন এবং তাঁকে গবেষণার জন্য উৎসাহ দেন।
● সন্ন্যাস জীবনের পাশাপাশি:
- তিনি অধ্যয়ন করেন গণিত, পদার্থবিদ্যা ও জীববিজ্ঞান
- কাজ করেন শিক্ষক হিসেবে
- প্রাকৃতিক নিয়ম বিশ্লেষণে গণনাভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন
গবেষণা কার্যক্রম : মটরশুটি পরীক্ষা
মেন্ডেলের সবচেয়ে বিখ্যাত গবেষণা ছিল মটরশুঁটির গাছে (Pisum sativum) উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ।
● পরীক্ষার সময়কাল:
১৮৫৬ – ১৮৬৩ পর্যন্ত প্রায় ৭ বছর
● তিনি পর্যবেক্ষণ করেন:
- ফুলের রঙ
- বীজের রঙ ও আকৃতি
- গাছের উচ্চতা
- বীজধারী ফ্লাওয়ার ও পডের বৈশিষ্ট্য
📌 তিনি প্রায় ২৮,০০০টির বেশি মটরগাছ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন!
মেন্ডেলের সূত্রসমূহ
১. সমজাতীয়তা ও আধিপত্য সূত্র (Law of Dominance)
দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সংকরায়নে আধিপত্যশীল বৈশিষ্ট্য প্রজন্মে প্রকাশ পায়।
📌 যেমন: হলুদ বীজ × সবুজ বীজ → হলুদ বীজ (কারণ হলুদ আধিপত্যশীল)
২. বিচ্ছিন্নতার সূত্র (Law of Segregation)
প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য দুটি উপাদান (এলিল) থাকে এবং প্রজননের সময় একটি এলিল পৃথক হয়ে যায়।
📌 এটি জিন-বিজ্ঞান ভিত্তির মূল ধারনা দেয়।
৩. স্বাধীন বণ্টন সূত্র (Law of Independent Assortment)
একাধিক বৈশিষ্ট্য একে অপরের প্রভাব ছাড়াই বণ্টিত হয়।
📌 এটি জিনগত বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে।
গণিত ও পরিসংখ্যানের ব্যবহার
মেন্ডেল প্রথম জীববিজ্ঞানী যিনি পরিসংখ্যান ও সম্ভাব্যতার ধারণা ব্যবহার করে জীববৈজ্ঞানিক ফলাফল বিশ্লেষণ করেন। তিনি কেবল পর্যবেক্ষণ করেননি, ফলাফল অনুপাত ও আনুমানিকতা দিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন। উদাহরণ:
- ৩:১, ৯:৩:৩:১ অনুপাতে বৈশিষ্ট্য বণ্টন
গবেষণাপত্র ও অবমূল্যায়ন
● তাঁর গবেষণাপত্র:
“Experiments on Plant Hybridization” (১৮৬৫ সালে উপস্থাপিত)
কিন্তু দুঃখজনকভাবে:
- সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা তা উপলব্ধি করেননি
- মেন্ডেলের কাজ প্রায় ৩৫ বছর অজ্ঞাত ছিল
- তিনিই জীবদ্দশায় সঠিক স্বীকৃতি পাননি
মৃত্যুবরণ
গ্রেগর মেন্ডেল মৃত্যুবরণ করেন ৬ জানুয়ারি ১৮৮৪, ৬১ বছর বয়সে, কিডনির সমস্যায়।
তাঁর মৃত্যু হয় অজ্ঞাতনামা একজন সন্ন্যাসী হিসেবেই।
পুনরাবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি
● ১৯০০ সালে তিনজন বিজ্ঞানী:
- হুগো ডি ফ্রিজ (Hugo de Vries)
- কার্ল কোরেন্স (Carl Correns)
- এরিক ভন শেরম্যাক (Erich von Tschermak)
তাঁরা আলাদাভাবে মেন্ডেলের কাজ আবিষ্কার করেন এবং একে স্বীকৃতি দেন।
📌 এর পর থেকেই মেন্ডেল “Genetics”-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
আধুনিক জীববিজ্ঞানে প্রভাব
● মেন্ডেলের সূত্র আজ ব্যবহৃত হয়:
ক্ষেত্র | প্রভাব |
---|---|
জীববিজ্ঞান | জিনতত্ত্বের মূল ভিত্তি |
কৃষি | সংকর জাত তৈরিতে |
চিকিৎসা | বংশগত রোগ নির্ণয়ে |
প্রাণী প্রজনন | গঠনগত উন্নয়নে |
● আধুনিক ধারণার ভিত্তি:
- DNA, Gene, Chromosome সবই মেন্ডেলীয় তত্ত্বের বর্ধিত রূপ
উপসংহার
গ্রেগর মেন্ডেল আমাদের শেখান—বিজ্ঞানে ধৈর্য, যুক্তি ও পরিসংখ্যানের একত্র প্রয়োগে সত্য উদ্ঘাটিত হয়।
যদিও তিনি জীবদ্দশায় অস্বীকৃত ছিলেন, কিন্তু আজ তাঁর কর্মই আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভিত্তি।
তিনি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে গেছেন—
“Knowledge delayed is not knowledge denied.”
https://www.munshiacademy.com/গ্রেগর-মেন্ডেল-আবিষ্কার-2/