কবীর চৌধুরী: জীবন, সাহিত্যকর্ম ও উত্তরাধিকার

কবীর চৌধুরী: জীবন, সাহিত্যকর্ম ও উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষাচিন্তা, সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ইতিহাসে কবীর চৌধুরী (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩—১৩ ডিসেম্বর ২০১১) এক উজ্জ্বল নাম। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং মুক্তচিন্তার দার্শনিক কণ্ঠ। প্রথিতযশা এই মনীষীকে সবাই চেনেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নামে, আর পরিবারে ডাকনাম ছিল ‘মানিক’। কেবল শিক্ষক বা লেখক হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও মানবিকতার অগ্রণী বুদ্ধিজীবী কণ্ঠ। তাঁর ছোট ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের শিকার; আরেক ভাই কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। পরিবার-ইতিহাসের এই বৈপরীত্যও কবীর চৌধুরীর জীবনকে অনন্য প্রেক্ষাপটে দাঁড় করায়।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
১৯২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্ম নেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তাঁদের পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগ গ্রামের মুন্সী বাড়িতে। পিতা খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আর মা আফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। কবীর চৌধুরীর পুরো নাম ছিল আবুল কালাম মোহাম্মদ কবীর।
শৈশবেই পরিবার থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত রচিত হয়। ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকে সপ্তম স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, এবং ১৯৪৪ সালে এমএ পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।
শিক্ষার এই দীপ্তি পরবর্তীতে তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দেয়। ১৯৫৭–১৯৫৮ সালে তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। আবার ১৯৬৩–১৯৬৫ সালে সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন: শিক্ষকতা থেকে জাতীয় অধ্যাপক
কর্মজীবন শুরু হয় সরকারি চাকরির মাধ্যমে। পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় প্রশাসনিক চাকরি ছেড়ে তিনি সম্পূর্ণ মন দেন শিক্ষাদানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন ছাত্রসমাজের প্রিয় শিক্ষক ও প্রজন্মের আলোকবর্তিকা।
১৯৯৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত করে। তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে “কালচার স্টাডিজ” পড়াতেন। তাঁর কর্মজীবন ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধির এক সুদীর্ঘ ভ্রমণ।
সাহিত্য ও অনুবাদকর্ম
কবীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম বহুমাত্রিক। তিনি প্রবন্ধ, গবেষণা, অনুবাদ, আত্মজীবনী ও শিশু সাহিত্য—সব ক্ষেত্রেই কাজ করেছেন।
শিশু সাহিত্য
বাংলাদেশে শিশু সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয় কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার, যা বাংলা একাডেমি প্রদান করে। তাঁর নিজস্ব রচনায়ও রূপকথা, কিশোর সাহিত্য রয়েছে।
মৌলিক গ্রন্থ
- রূপকথার কাহিনী (১৯৫৯)
- ইউরোপের দশ নাট্যকার (১৯৮৫)
- শেক্সপীয়র ও তাঁর মানুষেরা (১৯৮৫)
- অভিব্যক্তিবাদী নাটক (১৯৮৭)
- ফরাসি নাটকের কথা (১৯৯০)
- আধুনিক মার্কিন সাহিত্য (১৯৮০)
- আমেরিকার সমাজ ও সাহিত্য (১৯৬৮)
- ন্যুড চিত্রকর্ম (২০০৬)
- মানুষের শিল্পকর্ম (২০০৬)
আত্মজীবনী
- আমার ছোটবেলা (২০১২, মরণোত্তর প্রকাশিত)
অনুবাদ সাহিত্য
তাঁর অনুবাদে বাংলা পাঠক লাভ করেছে বিশ্বসাহিত্যের অসাধারণ সম্পদ।
- শেখভের গল্প (১৯৬৯)
- গ্রেট গ্যাটসবি (১৯৭১)
- দি গ্রেপস অব র্যথ (১৯৮৯)
- বেউলফ (১৯৮৫)
- অল দি কিংস মেন (১৯৯২)
- দি গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়ার রিং (২০০৭)
- ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী
নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তর
- আহবান (১৯৫৬)
- শত্রু (১৯৬২)
- শহীদের প্রতীক্ষায় (১৯৫৯)
- ছায়া বাসনা (১৯৬৬)
- সম্রাট জোনস (১৯৬৪)
- লিসিসস্ট্রাটা (১৯৮৪)
কাব্যনুবাদ
- ভাৎসারোভের কবিতা (১৯৮০)
- আধুনিক বুলগেরীয় কবিতা (১৯৮০)
- কাহলিল জিবরানের কবিতা (১৯৯২)
- সচিত্র প্রেমের কবিতা (২০০০)
পুরস্কার ও সম্মাননা
কবীর চৌধুরী তাঁর সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩)
- একুশে পদক (১৯৯১)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭)
- শেরে বাংলা পুরস্কার (১৯৮৯)
- ট্যাগোর পিস অ্যাওয়ার্ড, ভারত
- উইলিয়াম কেরী গোল্ড মেডেল
- ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড (২০০৪)
- নাগরিক নাট্যাঙ্গন সম্মাননা (২০০৫)
- গীতাঞ্জলি সম্মাননা (২০১০)
পারিবারিক জীবন
১৯৪৫ সালের জুন মাসে কবীর চৌধুরী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মেহের কবীরের সঙ্গে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
মৃত্যু
২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার নয়াপল্টনে নিজ বাসভবনে কবীর চৌধুরী পরলোকগমন করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। রাষ্ট্র তাঁকে জাতীয় মর্যাদায় সমাহিত করে, আর জাতি স্মরণ করে একজন নির্ভীক বুদ্ধিজীবীকে।
উপসংহার
কবীর চৌধুরীর জীবন শুধু শিক্ষকতা বা লেখালেখিতে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর অনুবাদে বাংলা পাঠক বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে; তাঁর প্রবন্ধে সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে; আর তাঁর শিক্ষাচিন্তা জাতীয় পর্যায়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
আজকের বাংলাদেশে যখন সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও বিভাজন আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন কবীর চৌধুরীর কণ্ঠস্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের পরম পরিচয় তার মানবিকতায়। তাই তিনি কেবল একজন শিক্ষাবিদ বা অনুবাদক নন, তিনি বাংলাদেশের আধুনিক নাগরিক চেতনার এক স্থায়ী আলোকবর্তিকা।