কবিয়াল ও কবিগান: ইতিহাস, বিকাশ ও জনপ্রিয়তা
কবিগানের পরিচয়
কবিগান বাংলা সাহিত্যের এক প্রাচীন ও জনপ্রিয় লোকনাট্যধর্মী সংগীতধারা, যা কেবল গান নয়, কাব্যিক বিতর্ক এবং সৃষ্টিশীল উপস্থাপনার এক অভিনব রূপ। এই ধারায় কবিয়াল নামক শিল্পীরা দলীয়ভাবে গান রচনা ও পরিবেশন করতেন। কবিগানের মূল বৈশিষ্ট্য তিনটি—
১. কাব্য ও সংগীতের মাধ্যমে তর্ক বা প্রতিযোগিতা করা।
২. একই শব্দের একাধিক অর্থ ব্যবহার করে বুদ্ধিদীপ্ত কাব্য রচনা।
৩. ছন্দ ও ভাষার গঠনে রূপান্তর বা ছন্দভঙ্গ ঘটিয়ে চমক সৃষ্টি করা।
কবিয়ালদের উত্থান
অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কবিগানের চর্চা বাংলায় সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বীরভূম জেলাকে কবিগানের একটি বড় কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়, যেখানে প্রায় তিনশ কবিয়াল সক্রিয় ছিলেন। এদের মধ্যে প্রাচীনতম কবিয়াল ছিলেন গোঁজলা গুঁই (জ. আনু. ১৭০৪), যিনি টপ্পা ও টিকারা ধারার সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। তার শিষ্যরাই পরবর্তীতে জনপ্রিয় কবিয়ালদের জন্ম দেন, যেমন: লালু-নন্দলাল, কেষ্টা মুচি, রঘুনাথ দাস এবং রামজি।
বিখ্যাত কবিয়ালগণ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কলকাতা এবং বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে কবিয়ালদের উত্থান ঘটে। তৎকালীন খ্যাতনামা কবিয়ালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হল—
- হরু ঠাকুর (১৭৪৯–১৮২৪)
- নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১)
- রাম বসু (১৭৮৬–১৮২৮)
- ভোলা ময়রা
- অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি
- যজ্ঞেশ্বরী দাসী
- ভবানী বণিক
অন্যদিকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক কবিয়াল খ্যাতি অর্জন করেন, যেমন—
- পণ্ডিত হরিনারায়ণ দে
- বলহরি দে (১৭৪৩–১৮৪৯)
- শম্ভুনাথ মণ্ডল (১৭৭৩-১৮৩৩)
- তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৫–১৯১৪)
- রমেশচন্দ্র শীল (১৮৭৭–১৯৬৭)
- রাজেন্দ্রনাথ সরকার, স্বরূপেন্দু সরকার, গৌতম মজুমদার, বিনয়কৃষ্ণ অধিকারী প্রমুখ।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস, যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে গান গেয়ে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর জীবনচরিত নিয়ে বালিকা বধূ নামে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও ভোলা ময়রা
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন এক পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত কবিয়াল। তিনি বাংলা ভাষায় অসাধারণ কবিগান পরিবেশন করতেন। তাঁর জীবনী অবলম্বনে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘জাতিস্মর’ নামক দুটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যেখানে অভিনয় করেন উত্তম কুমার ও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
অন্যদিকে ভোলা ময়রা ছিলেন এক স্বতঃস্ফূর্ত গায়ক ও কবিয়াল। তাঁর গান মানুষের মনে আলোড়ন তুলত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর প্রশংসা করে বলেন—
“বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনি দরকার ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের।”
তাঁর জীবন অবলম্বনেও ভোলা ময়রা নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়।
মুদ্রণ জগতে কবিগানের প্রবেশ
প্রথমদিকে কবিগান ছিল মৌখিক ধারার মাধ্যম। কবিগানকারেরা মুখে মুখে গান রচনা ও পরিবেশন করতেন। সে সময়ে ছাপাখানা না থাকায় এই শিল্পধারা লিখিত রূপ পায়নি। এমনকি পৃষ্ঠপোষক মহলেও এই গান সংরক্ষণের উদ্যোগ ছিল না। কবিগানের সার্থকতা ছিল এর আসর এবং জনসংযোগে।
১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বর গুপ্ত সর্বপ্রথম কবিগান সংগ্রহ করে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই কাজের ফলে কবিগান মুদ্রণ জগতে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা আরও বিস্তৃত হতে থাকে।
উপসংহার
কবিগান শুধু সংগীত বা কাব্যের একটি ধারা নয়, এটি ছিল বাংলার সমাজজীবন, বিনোদন এবং রাজনৈতিক চেতনার অংশ। এটি লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন, যেখানে কবিয়ালদের উপস্থিতি বাংলার সাহিত্য-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আজও এ ধারার ঐতিহ্য আমাদের লোকজ ঐক্য ও সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে বিবেচিত হয়।