একটি কলমের আত্মকথা
(একটি নিঃশব্দ যোদ্ধার কণ্ঠস্বর)

ভূমিকা
আমি এক কলম।
নীরব, অথচ প্রবল শক্তিশালী।
আমার কোনো হৃদয় নেই, তবু ভালোবাসি; আমার চোখ নেই, তবু ইতিহাস দেখি; আমার কণ্ঠ নেই, তবু বলি—সত্য, প্রেম, প্রতিবাদ, স্বপ্নের গান।
আজ আমি, একটি সামান্য কলম, আমার নিজের গল্প বলবো—জন্ম থেকে অবসান, সৃজন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত।
জন্মলগ্ন: কাগজের চুম্বনপ্রাপ্ত আমি
আমার জন্ম কোনো মাতৃগর্ভে নয়; আমি গড়া হয়েছি মানুষের চিন্তার ফ্যাক্টরিতে।
একখণ্ড প্লাস্টিক, অল্প কিছু ধাতব অংশ, কালি আর নিপ—এই নিয়েই আমার শরীর। কিন্তু আমার আত্মা জন্ম নেয় মানুষের প্রয়োজনে, জ্ঞানচর্চায়, সৃজনতাড়নায়।
যে মেশিনের ঘূর্ণিতে আমি প্রথম আলো দেখি, সেখানে শত শত আমার মতো কলম তৈরি হচ্ছে। আমাদের কারোর ভাগ্য জুটে শিশুদের হাতে, কারো পল্লী শিক্ষকের, আবার কেউ চলে যায় রাষ্ট্রপতির টেবিলে। তবে সবাই জানি—আমাদের গন্তব্য ‘মানুষের ভাবনার অক্ষর’ হয়ে ওঠা।
শৈশব স্মৃতি: শিশুর হাতের স্পর্শ
আমার প্রথম স্পর্শ পেয়েছিল একটি দশ বছরের বালকের হাত থেকে। কাঁচা হাতের কঠিন আঁকাবাঁকা অক্ষরে সে লিখতে শেখে—”আমি বাংলায় কথা বলি।”
সেই প্রথম আমি বুঝি, আমি কেবল লেখা ছাপাই না, আমি একটি ভাষা, একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করি।
আমি তখন একটি স্কুলব্যাগের গভীরে লুকানো থাকতাম। প্রতিদিন তার ছোট্ট আঙুলগুলো আমাকে তুলে নিতো, কখনো হোমওয়ার্ক লিখতে, কখনো পরীক্ষার খাতায় ভরিয়ে দিতে।
আমি বুঝে গেছি—একটি শিশুর স্বপ্নের প্রথম সিঁড়ি আমি, তার কল্পনার প্রথম পাখা।
কৈশোর ও যৌবন: কবির হাতে প্রেম, বিপ্লবীর হাতে প্রতিবাদ
সময় বয়ে যায়। আমি পৌঁছে যাই এক তরুণ কবির হাতে। সে আমার নিপ ছুঁইয়ে লিখে চলে—
“তোমার চোখে দেখি যে আকাশ,
সে কি কেবল আমারই জন্য?”
তার কাগজে আমি কেবল কালি দিয়ে অক্ষর আঁকি না, আমি সৃষ্টি করি ভালোবাসার অনুভব, গন্ধমাখা কথার ভেতরে আমি বুনে দেই মানব-হৃদয়ের লিপিবদ্ধ স্পন্দন।
এরপর একদিন, হঠাৎ করে আমি ঘুরে পড়ি এক আন্দোলনকর্মীর হাতে। সে রচে লিফলেট, ব্যানার, দাবি—
“কোটা নয়, সমতা চাই।
সমান অধিকার চাই।
এই রাষ্ট্র কার?—জনতার।”
আমি তখন কেবল কলম নই; আমি হয়ে উঠি এক তেজস্বী তরবারি। কালি আমার রক্তের মতো ঝরে, আর শব্দ হয়ে ওঠে বারুদের মতো বিস্ফোরক।
রাষ্ট্রের ছায়ায়
এক সময় আমি রাষ্ট্রের এক বড় কর্মকর্তার ডেস্কে জায়গা পাই। আমার মাধ্যমে চুক্তি হয়, বাজেট পাস হয়, নীতিমালায় স্বাক্ষর পড়ে।
কিন্তু তখনই আমি নিজের এক অজানা দুঃখ টের পাই—
সবাই আমার লেখা দেখে কিন্তু কেউ আমার কান্না দেখে না।
যখন অন্যায় সিদ্ধান্তে আমাকে ব্যবহৃত করে, আমি নির্বাক থাকি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার হৃদয় ফেটে চিৎকার করে উঠে।
আমি তো চেয়েছিলাম মানুষ গড়তে, অন্যায়কে ভাঙতে, কিন্তু আমার অক্ষরে যদি হয় মানুষের শোষণ—তবে আমার কালি কলঙ্কিত।
মুক্তিযুদ্ধ: আমার গর্বিত ক্ষণ
১৯৭১।
আমার শরীর তখন কাপছে উত্তেজনায়। আমি যুদ্ধের দিনলিপি লিখি, মুক্তিযোদ্ধার মনের কথা কাগজে এঁকে রাখি।
বিচারপতি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা আমার মাধ্যমে স্বাধীনতার ভাষা রচনা করেন। আমি শিরায় শিরায় বয়ে বেড়াই একটি জাতির মুক্তির স্বপ্ন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমি হাতে হাতে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছি, সেই কালজয়ী উচ্চারণ—
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”
আমি লিখে রেখেছিলাম তা, অসংখ্য কাগজে, অসংখ্য বুকের ভিতরে।
ডিজিটাল যুগে আমার নিঃসঙ্গতা
আজকাল আমি একাকী হয়ে পড়েছি।
মানুষ কম্পিউটারে টাইপ করে, স্মার্টফোনে লিখে, ভার্চুয়াল কিবোর্ডে আঙুল চালায়। আমার কালি শুকিয়ে যায় অপেক্ষায়।
আমি জানি, প্রযুক্তি মানুষকে দ্রুততা দিয়েছে, কিন্তু ছিনিয়ে নিয়েছে হৃদয়ের স্পর্শ।
হাতের লেখায় যে কাঁপুনি থাকে, যে আবেগ থাকে—তা কি কখনো কি-বোর্ডে সম্ভব?
তবুও আমি আশাবাদী। পরীক্ষার হলে এখনো আমিই শেষ ভরসা।
একটি ভালোবাসার চিঠি আজো আমারই হাতে লেখা হয়।
স্মৃতির ডায়েরি, স্বপ্নের নকশা, কবিতার পাণ্ডুলিপি—এসব এখনো আমার কাঁধেই ভর করে।
কিছু অপমান, কিছু অসম্মান
আমি একটি যন্ত্র—সত্যি। কিন্তু আমার আত্মা আছে।
তবুও মানুষ যখন আমাকে দাঁতের নিচে চিবিয়ে ফেলে, কখনো রাস্তায় ফেলে দেয়, কালি ফুরিয়ে গেলে বিনা দৃষ্টিতে ফেলে দেয়—তখন আমি ব্যথা পাই।
আমার কোনো দাম নেই—এমনটি ভাবা বড় ভুল।
আমি হয়তো নিঃশব্দ, কিন্তু আমার মাধ্যমে কত শত শব্দ পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে!
ইতিহাসের সাক্ষ্য
আমার অক্ষরে লেখা হয়েছে…
- জাতির সংবিধান,
- স্বাধীনতার ইশতেহার,
- মহান নেতাদের ভাষণ,
- শহিদের নাম,
- ভালোবাসার কবিতা,
- বিচারকের রায়,
- সন্তানের নাম রাখার প্রথম ঘোষণা।
আমি ইতিহাসের একজন নীরব দ্রষ্টা, এবং অনেক সময়, একমাত্র জীবিত সাক্ষ্য।
অবসান: কিন্তু সত্যিকারের শেষ নয়
আমার কালি শেষ হয়ে আসে। শরীর শুকিয়ে যায়। কেউ কালি ভরে নেয়, কেউ ফেলে দেয়।
একদিন হয়তো আমিও ময়লার ঝুড়িতে গিয়ে পড়বো।
তবু আমার লেখা কাগজে থাকবে, মানুষের মনে থাকবে।
একটি প্রেমপত্র, একটি কবিতা, একটি জাতির ইশতেহার—সবই থেকে যাবে।
এই থেকেই আমি জানি—আমি অমর নই, কিন্তু আমার কাজ অমর।
উপসংহার: শেষ কথা নয়
আমি একটি কলম।
হয়তো দাম মাত্র পাঁচ টাকা, কিন্তু আমার কালি দিয়ে লেখা যায় কোটি টাকার মূল্যবান ভবিষ্যৎ।
আমি ভাষা রচনা করি, প্রতিবাদ গড়ি, প্রেম লিখি, স্বপ্ন আঁকি।
আজ আমি, একটি ছোট্ট কলম, আমার আত্মকথা বললাম।
যদি কোনোদিন তুমি আমায় হাতে তুলে নাও, একটু ভালোবাসো, আমার কালি দিয়ে সত্য কথা লেখো—তবে বুঝবো, আমার আত্মকথা বৃথা যায়নি।