আবদুল মান্নান সৈয়দ: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love

আবদুল মান্নান সৈয়দ: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

 

 

 

 

 

 

 

 

 

🎉 জন্ম

আবদুল মান্নান সৈয়দ জন্মগ্রহণ করেন ৩ আগস্ট ১৯৪৩ সালে, পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট শহরে। দেশভাগের পরে তিনি পরিবারসহ পূর্ব বাংলায় চলে আসেন।

 

👨‍👩‍👧‍👦 পরিবার

তার পিতার নাম আবদুল মজিদ। পরিবারটি ছিল ধর্মনিষ্ঠ ও শিক্ষাবান্ধব। কৈশোরকাল থেকেই মান্নান সৈয়দ সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক দেখান। পারিবারিক আবহ তাঁকে আত্মিকভাবে গঠন করতে সহায়তা করে।

🎓 শিক্ষা

তিনি প্রথমে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশোনা করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও সাহিত্যনিষ্ঠ।

 

✍️ সাহিত্যিক জীবন

সব্যসাচী লেখক হিসেবে খ্যাত আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলা সাহিত্যের এমন এক শক্তিমান কলমযোদ্ধা, যিনি সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই রেখেছেন স্বতন্ত্র ছাপ। বলা হয়ে থাকে—বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো পরিশ্রমী লেখক বিরল। তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ পরীক্ষাগার, যিনি প্রতিটি লেখাতেই চালিয়েছেন নিরীক্ষা ও নব সৃষ্টির তৃষ্ণা।

🔹 পরাবাস্তববাদী কবিতা,
🔹 গভীর সাহিত্যসমালোচনা,
🔹 নিবিড় জীবনানুসন্ধানমূলক আত্মজৈবনিক রচনা—সবখানেই তিনি ছিলেন মৌলিক, প্রভাবশালী ও ব্যতিক্রম।

বাংলা কবিতায় তিনি যুক্ত করেন পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত, ভাষায় আনেন ব্যঞ্জনার রূঢ় সৌন্দর্য। তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বসাহিত্যের অগাধ পাঠ তাঁকে গড়ে তোলে এক তুলনারহিত সাহিত্য সমালোচক হিসেবে। নিজেই আক্ষেপ করে বলেছিলেন—

“মাইকেল, বঙ্কিম, ফররুখ, জসীমউদ্দীন ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে আরও বেশি কাজ করার ইচ্ছে ছিল আমার।”

ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও তিনি থেমে থাকেননি। সাহিত্য সাধনায় ছিল তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা।

📌 জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার জন্য তিনি ‘স্কলার-ইন-রেসিডেন্স’ পদে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-ইতিহাসে তিনিই প্রথম “পোয়েট-ইন-রেসিডেন্স”।

✍️ কবিতা

আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাটের দশকের সেই কবি, যিনি বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতাকে সাহসিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কাব্যচর্চার সূচনা ঘটে ১৯৫৯ সালে “সোনার হরিণ” কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত “জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ” তাঁকে বাংলা কাব্যভুবনে স্থায়ী আসনে বসায়।

🖋️ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: ২১টি
🖋️ বিষয় ও শৈলীতে: পরাবাস্তবতা, নন্দনতত্ত্ব, ধর্মীয় চেতনা, ভাষার কারুকার্য
🖋️ বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  • প্রতীক ও ব্যঞ্জনার অভিনব প্রয়োগ
  • অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, সনেট ও টানাগদ্যসহ বিভিন্ন ছন্দে চর্চা
  • অতীতের ছায়া থেকে বেরিয়ে আধুনিক কবিতার নতুন ভাষা নির্মাণ
  • নিরীক্ষাধর্মী ও বহুরূপী কাব্যচেতনা

কবিতাকে নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আত্মমগ্ন ও গভীরভাবে সৃজনশীল। নিজেই বলেছিলেন—

“কবিতা আমি তখনই লিখি, যখন কবিতা নিজে এসে আমার ওষ্ঠ চুম্বন করে।”

📘 নির্বাচিত কবিতা (২০০১) সংকলনগ্রন্থে তাঁর কবিকণ্ঠস্বর ও শৈল্পিক বৈচিত্র্যের এক অনবদ্য নিদর্শন পাওয়া যায়।

 

📚 তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • পিঞ্জরের গান (কবিতা)
  • জীবনানন্দ দাশ : শুদ্ধতার সাধক (গবেষণা)
  • কবিতার রূপরীতি
  • জীবনের কবিতা মৃত্যুর কবিতা
  • প্রেম ও নারী : নজরুলের কাব্যে
  • নজরুলের প্রেম ও বিদ্রোহ

🔍 তিনি বাংলা সাহিত্য বিশ্লেষণে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন। বিশেষত জীবনানন্দ দাশ ও নজরুল ইসলাম বিষয়ে তার গবেষণাগুলি একান্তই মৌলিক ও মূল্যবান।

কবিতা

  • জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭)
  • জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯)
  • ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪)
  • কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২)
  • পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮৪)
  • পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩)
  • মাছ সিরিজ (১৯৮৪)
  • সকল প্রশংসা তার (১৯৯৩)
  • নির্বাচিত কবিতা
  • আমার সনেট।

উপন্যাস

  • পরিপ্রেক্ষিতের দাস-দাসী
  • অ-তে অজগর (১৯৮২),
  • কলকাতা (১৯৮০),
  • ক্ষুধা প্রেম আগুন’ (১৯৯৪)
  • কলকাতা,
  • পোড়ামাটির কাজ,
  • হে সংসার হে লতা,

ছোটগল্প

  • সত্যের মতো বদমাশ
  • চলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩)
  • মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা
  • নেকড়ে হায়েনা
  • তিন পরী

প্রবন্ধ

  • বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা
  • দশ দিগণ্তের দ্রষ্টা
  • নির্বাচিত প্রবন্ধ
  • করতলে মহাদেশ
  • আমার বিশ্বাস,
  • ছন্দ।

স্মৃতিকথা

  • ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়
  • প্রণীত জীবন
  • স্মৃতির নোটবুক

গবেষণা গ্রন্থ

  • কালান্তরের যাত্রী।

জীবনী

  • নজরুল ইসলাম: কবি ও কবিতা
  • বেগম রোকেয়া
  • সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
  • সৈয়দ মুর্তাজা আলী
  • ফররুখ আহমদ
  • শাহাদাত্ হোসেন
  • জীবনানন্দ দাশ
  • প্রবোধচন্দ্র সেন
  • আবদুল গণি হাজারী
  • সৈয়দ মুর্তাজা আলী ।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সুনির্বাচিত কবিতা

গ্রন্থনা

  • জীবনানন্দ দাশের কবিতা
  • ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭৫)
  • ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খণ্ড ১৯৭৯)
  • ইসলামী কবিতা : শাহাদাত হোসেন (১৯৮৩)
  • বাংলাদেশের কবিতা (১৯৮৮)
  • বাংলাদেশের ছড়া (১৯৮৮)
  • মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন স্মৃতি অ্যালবাম (১৯৮৮)
  • সমরসেনের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯)
  • মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯)
  • বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০)।

জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থাবলি

  • শুদ্ধতম কবি (১৯৭২),
  • জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৩),
  • জীবনানন্দ (১৯৮৪),
  • জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৬),
  • জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (১৯৮৭),
  • জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)।

 

🧭 চরিত্র

আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন শুদ্ধতার সাধক ও আত্মনিবেদিত সাহিত্যিক। তিনি জীবনানন্দ-কে বলতেন “শুদ্ধতম কবি” এবং নিজ জীবনেও সেই শুদ্ধতার সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন।

🔸 রুচিশীল, সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন ও অভিমানী মানুষ ছিলেন তিনি।
🔸 তিনি হাস্যরসিক হলেও ছিলেন অন্তর্মুখী, নিজের কাজ আর সাধনায় সদা নিমগ্ন।
🔸 রাষ্ট্র ও সমাজের অবমূল্যায়নে একপ্রকার আত্মগ্লানি তাঁর মনে বাস করত।

📖 তিনি একবার বলেন:

> ❝আনন্দ কাকে বলে—আজ আর মনে নেই আমার।❞

 

এতসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েও তিনি ছিলেন একজন জীবিত, সজাগ ও মানবিক কবি।

🏆 পুরস্কার ও স্বীকৃতি

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য আবদুল মান্নান সৈয়দ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হন। নিচে তার প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি উল্লেখ করা হলো:

🔹 বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার — ১৯৮১
🔹 ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, চট্টগ্রাম — ১৯৯১
🔹 আলাওল সাহিত্য পুরস্কার — ১৯৯১
🔹 নজরুল পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ — ১৯৯৮
🔹 কবি তালিম হোসেন পুরস্কার — ২০০০
🔹 লেখিকা সংঘ পুরস্কার — ২০০০
🔹 নজরুল পদক — ২০০১
🔹 অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার — ২০০২
🔹 🇧🇩 একুশে পদক — (বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি)

 

🕊️ মৃত্যু

📅 ২৭ আগস্ট ২০১০-এ চ্যানেল আই-তে একটি আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন।
📅 ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০, ইফতারের কিছু আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুতে: 🔸 বাংলা একাডেমি
🔸 নজরুল ইনস্টিটিউট
🔸 সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়
🔸 অসংখ্য সাহিত্যিক ও শুভানুধ্যায়ী

—শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

📍 প্রথম জানাযা গ্রীনরোড,
📍 দ্বিতীয় জানাযা বাংলা একাডেমিতে,
📍 তৃতীয় জানাযা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়।
⚰️ সমাধিস্থ করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।

তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যজগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়।

 

 

https://www.munshiacademy.com/আবদুল-মান্নান-সৈয়দ-জীবন/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *