পথের পাঁচালী ফিল্মের রিভিউ

Spread the love

পথের পাঁচালী ফিল্মের রিভিউ

 

এক কালজয়ী বাংলা চলচ্চিত্রের রূপকথা

যখন এক জাতি,একটি ভাষা এবং একটি সংস্কৃতি নিজেকে পৃথিবীজুড়ে পরিচিত করানোর কথা ভাবতে থাকে, তখন এমন কিছু সৃষ্টির জন্ম হয়, যা তার সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন কিছু সৃজনশীল কাজ আছে,যেগুলো নিজস্ব যুগকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং শৈল্পিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই বিরল কাতারে স্থান পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত পথের পাঁচালী, যা বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি একদিকে যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের অনবদ্য চিত্রায়ন, তেমনি অন্যদিকে সিনেমাটির নির্মাণশৈলী, কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণের আধুনিকতার মাধ্যমে আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের একটি মাইলফলক হয়ে উঠেছে।

 

চরিত্রের চিত্রণ: এক প্রাণবন্ত বাস্তবতা

পথের পাঁচালী এর কেন্দ্রীয় চরিত্র অপু এবং দুর্গা—এই দুই ভাইবোনের সম্পর্ক একটি অত্যন্ত বাস্তব, অথচ অতি স্নেহময় ও আবেগপ্রবণ কাহিনির মূলে দাঁড়ায়। অপু, এক তরুণ, যার ভিতরে প্রবাহিত হয় অসীম কৌতূহল এবং জ্ঞানের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ, তার শৈশবের চিরন্তন প্রশ্ন এবং দুরন্ত অনুভূতি দর্শককে গভীরভাবে স্পর্শ করে। দুর্গা, যে শুধুমাত্র তার ভাইয়ের সাথে বুনে যায় একটি গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক, কিন্তু তার মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে একধরনের কল্পনা—একটি জীবন যা বাস্তবতার প্রহরগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে।অপুর মনে প্রতিটি দিন ঘুরে চলে নতুন কিছু শেখার, জানার, আর দুর্গার কাছে জীবন খুব সহজ। কিন্তু যখন দুর্গা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, অপু একাকী হয়ে যায়, তার পৃথিবী ধীরে ধীরে ভেঙে যায়, পৃথিবীটা শূন্য হয়ে যায়। এই দৃশ্যটি সিনেমার অন্তর্নিহিত নাটকীয়তা এবং মানবিকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

 

সিনেমার শৈলী: চিত্রায়ন, ক্যামেরার কৌশল এবং সঙ্গীত

সত্যজিৎ রায় একজন পরিচালক হিসেবে শুধু গল্প বলার চেষ্টায় ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন এক মহান শিল্পী, যিনি ক্যামেরা, সঙ্গীত এবং আলোর খেলা দিয়ে এক নিখুঁত চিত্রকর্ম রচনা করেছেন। সিনেমার শুরুতে, গ্রাম বাংলার প্রকৃতির যে নৈঃশব্দ্য, ধীর গতির চলাফেরা এবং মনের অবস্থা পরিপূরক সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটে ওঠে, তা দর্শককে এক পটভূমির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।বিশেষভাবে, রায়ের ক্যামেরার কাজ এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ শট, স্লো মোশন, ক্লোজ-আপ শট এবং দূরবর্তী শটগুলো গল্পের চরিত্রগুলির আবেগ ও অনুভূতি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে প্রকাশ করে। দূরের মাঠে ছুটে চলা দুর্গা কিংবা অপু, তাদের ছোট ছোট আনন্দকে জীবনের শুদ্ধতম মুহূর্ত হিসেবে তুলে ধরা, যেন তাদের চরিত্রের আত্মা দর্শক মনের মধ্যে বসিয়ে দেয়। এক বিশেষ শট যেখানে অপু ও দুর্গা মাঠে হাঁটছে, একযোগে জীবন এবং প্রকৃতির আবেগকে সেলুলয়েডে বন্দী করা, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনার অসাধারণতা তুলে ধরে।পথের পাঁচালী’র সঙ্গীত, বিশেষ করে রবিশঙ্করের সেতারের সুর, সিনেমার আবেগ এবং নাটকীয়তার গভীরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেতারের মৃদু সুর এবং তবলাগুলির গুণাবলী সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যে এক আশ্চর্য গতিশীলতা এনে দেয়। দুর্গার মৃত্যুর পর সঙ্গীতের মাধ্যমে যে আবেগ এবং একাকীত্ব ফুটে ওঠে, তা হৃদয়ে এক শোকাবহ অনুভূতি সৃষ্টি করে। সঙ্গীত এবং ক্যামেরার কাজ একে অপরকে পূর্ণ করে, যা সিনেমাটিকে একটি শক্তিশালী সৃজনশীল শিল্পকর্মে পরিণত করেছে।বিশেষ করে দুর্গার মৃত্যুর পর, সেতারের বেদনাদায়ক সুর সঙ্গীতের মাধ্যমে যন্ত্রণার এক মূর্ত চিত্র তৈরি করে, যা দর্শককে শোকের গভীরে ডুবিয়ে দেয়।

 

সিনেমার থিম:

পথের পাঁচালী শুধুমাত্র একটি গ্রামীণ পরিবারের গল্প নয়, এটি এক universal থিমের প্রকাশ—জীবনের অসীম সংগ্রাম, সম্পর্কের জটিলতা এবং মানবিক আবেগের এক চিরন্তন রূপ। সিনেমাটির থিম, যদিও গ্রামীণ জীবনের সহজ সৌন্দর্য এবং দুঃখের চিত্র, তবে এর মধ্যে যে গভীর জীবনদর্শন রয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে প্রতিটি দর্শককে আছড়ে পড়বে। রায় জীবনের নানা স্তরের দিকে সৃজনশীলভাবে আলোকপাত করেছেন, যা সিনেমাটিকে এক অমূল্য রত্নে পরিণত করেছে।

 

উপন্যাস থেকে সিনেমার রূপান্তর:

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পথের পাঁচালী ছিল এক স্বপ্নময় জীবনবোধের রচনা। রায় তাঁর সিনেমায় তা সফলভাবে পর্দায় জীবন্ত করে তোলেন। সিনেমার মাধ্যমে তিনি এমনভাবে জীবনের অনুভূতি, সম্পর্ক এবং সংগ্রামকে চিত্রিত করেছেন যে, তা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের যে বিস্তারিত রূপকথা ছিল, তা সিনেমায় রায়ের পরিচালনা, অভিনয় এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে এক আত্মিক পরিসরে পরিণত হয়েছে। সিনেমায় যে সহজতর, অথচ শুদ্ধ বাস্তবতা রয়েছে, তা বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং বাস্তব।

 

বিশ্ব চলচ্চিত্রের অঙ্গনে পথের পাঁচালী’র অবদান:

পথের পাঁচালী শুধু বাংলা সিনেমার নয়, এটি একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি। কানে চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কৃত হওয়ার পর এটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রমহলে এক নতুন আলো ছড়িয়েছে। রায়ের নির্মাণশৈলী এবং সিনেমাটির সৃজনশীলতা এতটাই অনবদ্য ছিল যে, তা সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য এক নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ব্যাপক প্রশংসিত হওয়ার পর পথের পাঁচালী চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে।

 

উপসংহার:

পথের পাঁচালী আজও শুধু একটি সিনেমা হিসেবে নয়, বরং জীবনের অমোচনীয় বাস্তবতা, সম্পর্ক এবং মানবিক মূল্যবোধের এক চিরন্তন চিত্র হয়ে রয়েছে। এটি শুধু একটি কাহিনী নয়, এটি মানুষের অন্তর্নিহিত আবেগ, আশা, স্বপ্ন এবং ভেঙে পড়া সংগ্রামের এক অতুলনীয় রূপ। সত্যজিৎ রায় এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে এক অসীম শক্তি, যা মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়, হৃদয়ে গেঁথে যায়। পথের পাঁচালী কেবল বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য নয়, পৃথিবীজুড়ে সকল মানুষের জন্য এক অমূল্য রত্ন হয়ে থাকবে।

 

লেখক: মোঃ আবু মুসা আসারি

ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, সাহিত্যপ্রেমী

email: musasirajofficial@gmail.com

https://www.munshiacademy.com/পথের-পাঁচালী-ফিল্মের-রিভ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *