সংকল্প – কাজী নজরুল ইসলাম
থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।
কিসের আশায় করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে
কেমন করে বীর ডুবুরি
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী
চলছে উড়ে স্বর্গপানে।
হাউই চড়ে চায় যেতে কে
চন্দ্রলোকের অচিনপুরে,
শুনব আমি, ইঙ্গিতে কোন
মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।
পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
‘সংকল্প’ কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যা , প্রশ্ন ও উত্তর , শব্দার্থ
উদ্দীপনামূলক রচনা, যেখানে মানুষের জ্ঞান-পিপাসা, দুঃসাহস এবং বিশ্বজয়ের অদম্য আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। কবি এখানে কিশোর মননের এক স্বপ্নজগৎ নির্মাণ করেছেন—যেখানে সে কেবল বসে থাকতে চায় না, বরং ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চায় অজানাকে জানার আকুল ইচ্ছায়।
এই কবিতার মূল ভাবগুলো হলো—
১. বিশ্ব জানার আগ্রহ ও কৌতূহল:
কবিতায় ফুটে উঠেছে সেই কিশোর মনে জন্ম নেওয়া প্রশ্ন—“এই বিশাল দুনিয়াটা কেমন?” এই প্রশ্নের উত্তর জানতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় অজানার মধ্যে। সে মহাশূন্য, মহাসাগর কিংবা পর্বতের রহস্য জানার স্বপ্ন দেখে।
২. ঘরবন্দি জীবন নয়, মুক্ত বিশ্ব দরকার:
কবি বলেন, সে আর বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালে থাকতে চায় না। বাইরের বিশাল প্রকৃতিই তার কাছে শ্রেয়। সেখানেই রয়েছে জীবনের সত্য, প্রকৃত অভিজ্ঞতা ও বোধের ভাণ্ডার।
৩. সাহসী মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা:
সংকল্প কবিতায় ডুবুরি, পর্বতারোহী বা মহাকাশ অভিযাত্রীদের মতো সাহসী মানুষদের প্রতি কবির শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তারা ভয় না পেয়ে জীবন বাজি রেখে বিশ্বকে জানার জন্য কাজ করে চলেছে।
৪. বিশ্বজয়ের দৃঢ় সংকল্প:
এই কবিতায় কবি এমন এক চিন্তাভাবনার জন্ম দিয়েছেন যেখানে মানুষ নিজের সাহস, জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে জয় করতে চায়। সে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় আকাশ, ছুঁতে চায় তারা, এবং জানতে চায়—‘আমরা কোথা থেকে এলাম, কেন এলাম?’
উপসংহার:
‘সংকল্প’ কবিতাটি শুধু একটি শিশুর স্বপ্ন বা কল্পনা নয়, বরং তা মানুষের অন্তর্নিহিত সাহস, কৌতূহল ও বিস্ময়বোধের প্রতিফলন। এটি পাঠকের মনে জাগায় অনুপ্রেরণা—নিজেকে সীমাবদ্ধতার বাইরে নিয়ে গিয়ে জগতকে জানার জন্য এক অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার।
সারাংশে বলা যায়:
এই কবিতা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন, জ্ঞানার্জনের আগ্রহ ও সাহসী অভিযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিশোরদের মনে দুর্বার স্পৃহা সৃষ্টি করে।
প্রদত্ত শব্দ ও অর্থ
শব্দ | অর্থ |
---|---|
সংকল্প | প্রতিজ্ঞা, দৃঢ় ইচ্ছা |
বদ্ধ | বন্ধ, আবদ্ধ |
যুগান্তর | এক যুগ থেকে আরেক যুগ; সময়ের বড় পরিবর্তন |
দেশান্তর | এক দেশ থেকে অন্য দেশে গমন |
কিসের নেশায় | কী আকর্ষণে বা কী উদ্দেশ্যে |
বরণ | সাদরে গ্রহণ করা |
মরণ-যন্ত্রণা | মৃত্যুর মতো তীব্র কষ্ট |
ডুবুরি | পানিতে ডুব দিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তি |
দুঃসাহসী | অত্যন্ত সাহসী ব্যক্তি |
চন্দ্রলোক | চাঁদের দেশ বা জগত |
অচিনপুর | অজানা, অচেনা জায়গা |
ফেড়ে | চিরে, ফাটিয়ে |
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন ১: কবি কোথায় যেতে চান?
উত্তর: কবি মহাসাগরের তলদেশে, মহাশূন্যে এবং অচিনপুরের চন্দ্রলোকে যেতে চান।
প্রশ্ন ২: কবি বদ্ধ ঘরে থাকতে চান না কেন?
উত্তর: তিনি বিশ্বজগতের রহস্য জানতে চান, তাই তিনি ঘরে বসে থাকতে চান না।
প্রশ্ন ৩: ‘ডুবুরি’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: ডুবুরি হলো সেই ব্যক্তি, যে পানির নিচে গিয়ে মুক্তা বা মূল্যবান বস্তু সংগ্রহ করে।
প্রশ্ন ৪: কবি কার মতো সাহসী হতে চান?
উত্তর: কবি ডুবুরি, বৈমানিক ও দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের মতো সাহসী হতে চান।
প্রশ্ন ৫: ‘অচিনপুর’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: ‘অচিনপুর’ মানে হলো অজানা ও অচেনা জায়গা, যেমন চাঁদের দেশ বা চন্দ্রলোক।