ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: জীবনী

🔶 ভূমিকা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—একটি নাম নয়, একটি আন্দোলনের নাম। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, বাঙালি রেনেসাঁসের পথিকৃৎ এবং সর্বোপরি একজন মানবতাবাদী। তাঁর চিন্তা, কর্ম এবং জীবনদর্শন আজও আমাদের সমাজ, শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতিটি স্তম্ভে গভীর ছাপ রেখে চলেছে। ব্রাহ্মণ সমাজে জন্ম নিয়ে, প্রচলিত রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে সমাজকে নতুন পথ দেখিয়েছেন তিনি—সাহসের সঙ্গে, যুক্তির সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে।
🔶 জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয় ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ নামক একটি অখ্যাত গ্রামে। তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন গরিব ব্রাহ্মণ, যিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন পুরোহিতি করে। মাতা ভগবতী দেবী ছিলেন এক আদর্শ ভারতীয় গৃহিণী—সহানুভূতিশীল ও আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ।
শৈশব থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন অপার জ্ঞানপিপাসু, দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এবং ন্যায়ের প্রতি অটল। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি নির্ভীকভাবে শিক্ষা অর্জনের পথে এগিয়ে যান। কুপি বাতির আলোয় রাতে পড়াশোনা করা, পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল দূরের স্কুলে যাওয়া—এই সবকিছুই ছিল তাঁর জীবনযুদ্ধের অংশ।
🔶 ছাত্রজীবন ও “বিদ্যাসাগর” উপাধি লাভ
কলকাতায় এসে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন ১৮২৯ সালে। এখানে তিনি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গ্রন্থানুগ ব্যাকরণ, কাব্য, দর্শন, স্মৃতি ও তর্কশাস্ত্রে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি একাধিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কলেজের সেরা ছাত্র নির্বাচিত হন।
তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে দেন “বিদ্যাসাগর” উপাধি, যার অর্থ “বিদ্যার সাগর” বা “জ্ঞানসমুদ্র”—এমন একটি উপাধি যা আজ পর্যন্ত অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি।
🔶 কর্মজীবন: শিক্ষা ও প্রশাসনে নেতৃত্ব
ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সহপাঠ্য পণ্ডিত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সংস্কৃত কলেজে ফিরে এসে তিনি সহকারী সম্পাদক, অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ হন।
তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে একাধিক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন:
- শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রদের চিন্তা ও যুক্তি প্রয়োগের ওপর জোর দেন
- সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমে যুক্ত করেন
- শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি, ছাত্রদের উপস্থিতি ও মূল্যায়নের জন্য কঠোর নীতিমালা চালু করেন
- কলেজের ভেতরে ধর্মীয় বিভাজন ও জাতপাতের প্রভাব দূর করতে উদ্যোগী হন
১৮৫৫ সালে তিনি “স্কুল ইন্সপেক্টর” হিসেবে নিযুক্ত হন এবং বাংলার গ্রামে-গঞ্জে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য শতাধিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষা চালুর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক পুরোধা ব্যক্তি।
🔶 নারী শিক্ষা ও হিন্দু বিধবা বিবাহ আন্দোলন
ঊনবিংশ শতকের হিন্দু সমাজ ছিল নারীদের জন্য এক ভয়ংকর কারাগার। পিতার ঘরে অধিকার নেই, স্বামীর ঘরে সম্মান নেই, আর স্বামী মারা গেলে বিধবার জীবন হয়ে উঠত এক নিরন্তর শাস্তি। এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন বিদ্যাসাগর।
✅ নারী শিক্ষায় অবদান:
- ৩৫টিরও বেশি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন
- হিন্দু ও মুসলমান উভয় পরিবারের মেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেন
- নারীশিক্ষার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেন (যেমনঃ বর্ণপরিচয়)
- নিজ খরচে অনেক দরিদ্র ছাত্রীকে সহায়তা করেন
✅ বিধবা বিবাহ প্রচলনে ভূমিকা:
তিনি যুক্তির মাধ্যমে দেখান যে, হিন্দু ধর্মে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। এর পক্ষে তিনি “পরমার্থদর্শন”, “বিধবাবিবাহ-প্রসঙ্গ” প্রভৃতি পুস্তিকা রচনা করেন। বহু প্রতিকূলতা ও রক্ষণশীলদের হুমকির মুখে তিনি আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
ফলস্বরূপ ১৮৫৬ সালে পাশ হয় “হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন”, যা ছিল ভারতীয় সমাজে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
🔶 বাংলা সাহিত্য ও ভাষার সংস্কারক
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষাকে গঠন করেন। সে যুগে বাংলা গদ্য ছিল সংস্কৃতময়, দুর্বোধ্য ও কৃত্রিম। তিনি সেটিকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে গড়ে তোলেন।
📚 তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম:
- বর্ণপরিচয় (খণ্ড ১ ও ২): বাংলা ভাষা শেখার সর্বপ্রথম ও জনপ্রিয় পাঠ্যবই
- শকুন্তলা: সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ
- বেতাল পঁচিশি: রূপকথা ও নীতিকথার সংমিশ্রণ
- সীতার বনবাস: মানবিক ও নারীকেন্দ্রিক ভাবনার প্রতিফলন
- ভ্রান্তিবিলাস: নাট্যরূপে সামাজিক ব্যঙ্গ
তিনি বাংলা ছাপাখানার উন্নয়ন, ছাপা বইয়ের মান ও বানানরীতি প্রণয়নের কাজেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
🔶 নৈতিকতা, দানশীলতা ও ব্যক্তিজীবন
বিদ্যাসাগর ছিলেন এক মহৎ নৈতিক চরিত্রের মানুষ। সাধারণ জীবনযাপন, কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সমাজসেবায় আত্মনিবেদন ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য।
তিনি তাঁর নিজের উপার্জিত অর্থ গরিব ছাত্র ও মেয়েদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় করতেন। তাঁর উদারতা ও দানশীলতা কিংবদন্তি হয়ে আছে।
একসময় সরকার তাঁকে “সিআই” খেতাব (Companion of the Indian Empire) দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।
🔶 মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই, ৭০ বছর বয়সে কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুসংবাদে গোটা বাংলা কেঁদে ওঠে। হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্ম—সকল সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন।
তিনি রেখে যান একটি আদর্শ, একটি সংগ্রাম, এবং একটি শিক্ষিত সমাজ গঠনের মূলমন্ত্র।
🔶 বিদ্যাসাগরের জীবনের মূল্যায়ন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের প্রথম স্তম্ভ। তাঁর জীবন ছিল সুশিক্ষা, যুক্তিবাদ ও মানবিকতার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন:
“বিদ্যাসাগরের চরিত্র ছিল হিমালয়ের মতো উচ্চ, বিবেক ছিল বেদান্তের মতো গভীর।”
🔶 উপসংহার
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন আমাদের শেখায়—একজন মানুষ, তাঁর একাকী সাহসিকতায় কিভাবে গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারেন। তিনি আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, যাঁর আলো চিরকাল আমাদের পথ দেখাবে। নারী শিক্ষা, সামাজিক সমতা ও বাংলা ভাষার উন্নয়নে তাঁর অবদান আজও প্রতিটি প্রগতিশীল চেতনাকে অনুপ্রাণিত করে।
📌 তথ্যসারাংশ (সারণি)
বিষয় | তথ্য |
---|---|
পূর্ণ নাম | ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় |
উপাধি | বিদ্যাসাগর (বিদ্যার সাগর) |
জন্ম | ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০, বীরসিংহ, পশ্চিমবঙ্গ |
মৃত্যু | ২৯ জুলাই ১৮৯১, কলকাতা |
পিতা | ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় |
মাতা | ভগবতী দেবী |
প্রধান পরিচয় | সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, লেখক |
উল্লেখযোগ্য কাজ | বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন, নারী শিক্ষা, বাংলা গদ্যের সংস্কার |
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ | বর্ণপরিচয়, বেতাল পঁচিশি, সীতার বনবাস, শকুন্তলা |
শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠান | সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা |
সম্মাননা | “বিদ্যাসাগর” উপাধি (১৮৩৯), সিআই (প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান) |