প্রবন্ধ: শৈশব – স্মৃতি
(একটি হারিয়ে যাওয়া দিনের আলেখ্য)

ভূমিকা
জীবনের প্রতিটি মানুষকেই একদিন বড় হয়ে যেতে হয়। কিন্তু বড় হওয়ার পরেও একটা সময় বারবার ফিরে আসে—স্মৃতির জানালা খুলে সবার আগে যে মুখটা উঁকি দেয়, তা হলো শৈশব।
আমি আজও মনে করতে পারি সেইসব দিন, যেগুলো ছিলো বাঁধনহীন, চিন্তামুক্ত, নির্ভেজাল আনন্দে ভরা। তখন জীবনের কোনো জটিলতা ছিল না, ছিল না ক্লান্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা পরিণতির ভয়। শুধু ছিল মুক্ত আকাশের নিচে ছোটাছুটি, মাটির গন্ধে গড়া দিন, পুকুরের জলে ভেজা দুপুর, বাঁশবাগানের ছায়া, আর একটুকরো ভালোবাসার পৃথিবী।
আজ আমি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা বলবো—আমার শৈশবের স্মৃতি।
জন্ম ও প্রথম দিনগুলি
আমার জন্ম হয়েছিলো বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রামে। আশেপাশে ছিলো সবুজ ধানক্ষেত, তালগাছের সারি, কাঁচা রাস্তা আর ছোট ছোট কুঁড়েঘর। বাড়ির পাশে ছিলো একটা পুকুর, যেখানে আমার জীবনের প্রথম সাঁতার শেখা, মাছ ধরা, আর ডুবে যাওয়ার গল্পগুলো গাঁথা।
আমার শৈশবের প্রথম স্মৃতি জড়িত মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়া আর বাবার কাঁধে চড়ে গ্রাম ঘোরা। তখন আমার কাছে পৃথিবীটা খুবই ছোট ছিল—আমার ঘর, উঠোন, খেলার মাঠ, আর মসজিদের পাশের পুরোনো আমগাছটাই ছিল আমার ‘বিশ্ব’।
খেলার দিনগুলি
শৈশব মানেই খেলা, আর খেলা মানেই আনন্দ। আমার শৈশবে ছিলো হাজারো খেলার স্মৃতি—
গোল্লাছুট, বউচি, কানামাছি, সাতচাড়া, লুকোচুরি, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা—এই নামগুলোই যেন এখন স্মৃতির দরজায় টোকা দেয়।
আমরা দুপুরের খাওয়া শেষ করেই মাঠে ছুটতাম। কখনো বৃষ্টিতে ভিজে গলাগলি খেলতাম, কখনো কাঠালপাতা দিয়ে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিতাম ডোবার জলে।
মাঠে পড়ে গিয়ে কাদা মেখে শরীর, হাতে পায়ে ক্ষত, তবুও মুখে হাসি—এসবই ছিলো জীবনের অমূল্য সম্পদ।
বিকেল হতো কাঁঠাল গাছের ডালে দোল খেতে খেতে। সন্ধ্যা নামার আগে ‘মা’ ডেকে বলতেন, “আয় ঘরে, বেশি খেললে অসুখ হবে।”
গ্রামীণ শৈশবের সৌন্দর্য
গ্রামে বড় হওয়ার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য ছিল প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধন।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কুয়াশার চাদর মাড়িয়ে স্কুলে যাওয়া, রাস্তার পাশে কুড়ানো শিউলি ফুল, মাঠে ঘাসে ভেজা পা—এসব ছিলো যেন দৈনন্দিন সৌন্দর্য।
আমাদের গ্রামের পাশেই ছিলো একটি বিল। বর্ষাকালে সেখানে নৌকা চলে, শীতে শালিকের ঝাঁক নামে, আর বসন্তে কাশফুলের মাঝে আমরা দৌড় দিতাম।
আমাদের বাড়ির আঙিনায় বসানো ছিলো দাদুর বানানো কাঠের দোলনা। সেখানে বসে শুনতাম ঠাকুমার মুখে গল্প—”এক যে ছিল রাজা, এক যে ছিল রানী…”
সেই কল্পনার রাজ্যই ছিলো আমাদের বাস্তব জগৎ।
স্কুল জীবন ও বন্ধুতা
আমার প্রথম স্কুল ছিলো একটি কাঁচা বাড়িতে, টিনের চালা। স্কুলের নাম ছিল “মঙ্গলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।” সেখানেই প্রথম আমি “অ আ ক খ” শিখি, প্রথম “আমি ভাত খাই” লিখতে শিখি। সেই স্কুলের শিক্ষক মিজান স্যারকে আমি আজও ভুলতে পারি না—যিনি মাটি দিয়ে অক্ষর এঁকে শেখাতেন।
আমার শৈশবের বন্ধুদের কথা মনে পড়লেই মন ভরে ওঠে। রফিক, মামুন, লাবলু, মুন্নি—ওদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি দিন যেন সোনার খাঁচায় বন্দী সময়। আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম, দুপুরে আম গাছের ছায়ায় বসে টিফিন খেতাম, আবার বিকেলে একসঙ্গে খেলার মাঠে যেতাম।
স্কুলের শেষ ঘণ্টা বাজলে সবাই দৌড় দিতাম বাড়ির দিকে, কিন্তু পথে আবার খেলায় ব্যস্ত হয়ে যেতাম। কেউ গাছ বেয়ে উঠে আম পাড়তো, কেউ বাঁশের ঝোপে লুকিয়ে থাকতো। আনন্দের কোনো সীমা ছিল না, শুধু ছিল সময়ের অবাধ প্রবাহ।
ঈদ, পূজা আর উৎসব
শৈশব মানেই উৎসবের দিনগুলো ছিল জাদুকরী।
ঈদের দিন সকালবেলা নতুন জামা পরে, মায়ের হাতে সেমাই খেয়ে মসজিদে যেতাম। সবাইকে সালাম করতাম, পকেটভর্তি সালামির টাকা নিয়ে বানাতাম কাগজের ঘুড়ি।
পূজার সময় স্কুলে ছুটি থাকতো। তখন আমরা হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি যেতাম। প্রসাদ খাওয়া, রঙিন বাতি দেখা আর বিসর্জনের সময় ঢাকের তালে তালে নাচা—সবই ছিলো এক অপার মিলনের মুহূর্ত।
এইসব উৎসব আমাদের হৃদয়ে গেঁথে দিতো ভালোবাসার পাঠ, মানবতার পাঠ।
বৃষ্টির দিন ও শরতের আকাশ
শৈশবের বৃষ্টির দিন ছিল অন্যরকম। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙতো, মায়ের কোল থেকে না উঠে বৃষ্টি দেখা—এ যেন ছিল এক অনন্য অনুভূতি।
আমরা কখনো কাদা জলে নেমে পিচ্ছিল পথে দৌড়াতাম, আবার বৃষ্টির পানিতে ভাসাতাম কাগজের নৌকা।
শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসতো। আমরা ঘুড়ি ওড়াতাম, কাশফুলের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম।
সে সময় জীবনের মানে ছিল—মেঘ, আকাশ, বাতাস, খেলা আর গান।
দাদুর গল্প, ঠাকুমার গান
আমার শৈশবের রাতগুলো ছিলো গল্পে মোড়া।
দাদু আমাদের নিয়ে বসে গল্প করতেন মহাভারতের, মুক্তিযুদ্ধের, আবার কখনো তাঁর নিজের জীবনের।
ঠাকুমা শোনাতেন পালাগান, কবিগান, আর lullaby ধরনের ছড়া।
সে সময় ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেনের আলোয়, কেরোসিন বাতির পাশে বসে গল্প শোনা ছিলো এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা।
শৈশবের শিক্ষা ও মূল্যবোধ
আমার শৈশবে শিখেছি—
- বড়দের সম্মান করতে হয়,
- ছোটদের ভালোবাসতে হয়,
- গাছ লাগাতে হয়,
- পাখিকে বিরক্ত করা ঠিক না,
- মিথ্যা বলা পাপ।
এইসব ছোট ছোট কথা জীবনের বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হারিয়ে যাওয়া দিন
সময় থেমে থাকে না। আমিও বড় হয়ে যাই। শহরে চলে আসি, নতুন জীবন, চাকরি, পরিবার—সব কিছুতেই শৈশব কোথায় যেন ফিকে হয়ে যায়।
আজ চোখ বন্ধ করলেই দেখি—সেই পুরোনো মাঠ, সেই তালগাছের ছায়া, সেই বাঁশঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিকেল।
রফিক আর মামুন আজ কে কোথায় জানি না, স্কুলও এখন টিনের বদলে কংক্রিটের, মাঠে এখন আর কাঁঠাল পড়ে না।
বর্তমান ও শৈশবের গুরুত্ব
আজকের যান্ত্রিক জীবনে দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারি—শৈশব শুধু সময় নয়, এটি আত্মার আশ্রয়।
যখন ক্লান্ত হই, ব্যর্থ হই, তখনই শৈশবের স্মৃতি আমায় সাহস দেয়, হাসায়।
শৈশবই মানুষকে মানুষ করে তোলে। আজকের আমি, যে-আমি টিকে থাকার জন্য লড়ি, স্বপ্নের পেছনে ছুটি—সে তো তৈরি হয়েছে সেই শৈশবেই।
উপসংহার
শৈশব কখনো ফেরে না, কিন্তু স্মৃতি হয়ে থাকে আজীবন।
আমার শৈশব হয়তো ছোট্ট এক গ্রামের গল্প, কিন্তু সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
আজ আমি চাই, প্রতিটি শিশুর শৈশব হোক এমন মুক্ত, এমন আনন্দময়, এমন মানবিক।
আমি আজও হৃদয়ে সেই দিনগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ। কারণ যদি শৈশব না থাকতো, আমি কখনোই জানতে পারতাম না ভালোবাসা কী, প্রকৃতি কী, জীবন কী।