ডিগ্রিকে স্নাতক বলা হয় কেন?

Spread the love

ডিগ্রিকে স্নাতক বলা হয় কেন?

(একটি ঐতিহাসিক, ভাষাবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা)

🟠 প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার পটভূমি

‘স্নাতক’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে একটি ডিগ্রি অর্জনের গর্বিত মুহূর্ত—যখন একজন শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা সমাপ্ত করে ডিগ্রি লাভ করে। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, কেন এই ডিগ্রিকে “স্নাতক” বলা হয়? এর পেছনে রয়েছে প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার এক গভীর ঐতিহ্য।

প্রাচীন ভারতে শিক্ষালাভের প্রধান কেন্দ্র ছিল গুরুগৃহ বা আশ্রম। সেখানে ছাত্ররা গুরুজনের তত্ত্বাবধানে কঠোর নিয়ম, শৃঙ্খলা ও সাধনার মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন করত। এই শিক্ষা ছিল কেবল বইপুস্তকে সীমাবদ্ধ নয়; আত্মসংযম, নৈতিকতা, ধর্মচর্চা, সংস্কার ও শুদ্ধতা ছিল শিক্ষার অপরিহার্য অংশ।

যখন কোনো ছাত্র দীর্ঘ সময় ধরে পাঠ গ্রহণের পর তার বিদ্যা অর্জন সম্পূর্ণ করত, তখন গুরু নিজে সেই শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতেন যে সে এখন জীবনযুদ্ধে প্রবেশের উপযুক্ত। সেই সময় গুরু তাকে একটি সনদ প্রদান করতেন, যা আজকের ‘ডিগ্রি’র মতোই তার শিক্ষার স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু এই ‘সনদ’ গ্রহণ প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ রীতিনীতি ও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ।

🟢‘স্নান’ এবং ‘স্নাতক’ নামকরণের তাৎপর্য

এই ডিগ্রি বা সনদ গ্রহণের আগের দিন শিক্ষার্থীকে ‘স্নান’ করতে হতো। এটি কেবল শারীরিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং এটি ছিল এক ধরনের আধ্যাত্মিক শুদ্ধিকরণ। স্নানের মাধ্যমে সে বাহ্যিক ও অন্তরঙ্গ পবিত্রতা অর্জন করে নতুন বস্ত্র পরে নির্দিষ্ট আসনে বসত। একইভাবে গুরুজনও স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে এসে শিক্ষার্থীকে আশীর্বাদ করতেন ও বলতেন—
“তোমার জ্ঞানলাভ পূর্ণ হয়েছে।”

এই মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের শেষ ধাপে এই ‘স্নান’ এবং ‘সনদ’ গ্রহণের মধ্যে একটি পবিত্রতা, দীক্ষা ও আত্মিক সেতুবন্ধ ছিল। যেহেতু এই সনদ গ্রহণের সময় শিক্ষার্থী স্নান করে পবিত্র হয়ে তা গ্রহণ করত, তাই সেই ডিগ্রিকে বলা হতো—“স্নাতক”
‘স্নাত’ শব্দের অর্থ হলো ‘স্নান-সম্পন্ন’ আর ‘স্নাতক’ হলো সেই ব্যক্তি, যিনি স্নান করে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষালাভের পর গুরু থেকে সনদ লাভ করেছেন।

তাই ‘স্নাতক’ শুধু একটি ডিগ্রির নাম নয়, এটি এক ঐতিহাসিক আধ্যাত্মিক রীতির প্রতিফলন, যেখানে শিক্ষা ছিল দীক্ষার মতোই পবিত্র ও জীবনমুখী। কালক্রমে এই প্রথা থেকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় “স্নাতক ডিগ্রি” শব্দটি প্রচলিত হয়ে যায়।

আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ডিগ্রি আমরা অর্জন করি, সেটিও ‘স্নাতক’ নামে পরিচিত থাকে— যেমন: স্নাতক (বিএ), স্নাতক (বিএসসি), স্নাতক (বিকম)। যদিও এখন আর শিক্ষার্থীরা স্নান করে গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে সনদ গ্রহণ করে না, তবে সেই ঐতিহ্যবাহী নামটি এখনো বেঁচে আছে আমাদের ভাষা ও শিক্ষায়।

‘স্নাতক’ শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়— শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য বা ডিগ্রি নয়, বরং এটি একটি সাধনা, এক শুদ্ধ পথের অনুসরণ।

https://www.munshiacademy.com/ডিগ্রিকে-স্নাতক-বলা-হয়-ক/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *