আলফ্রেড নোবেল : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

Spread the love

আলফ্রেড নোবেল : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

ভূমিকা

আধুনিক বিজ্ঞান ও মানবকল্যাণের অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণার নাম আলফ্রেড নোবেল (Alfred Nobel)। তিনি ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, শিল্পপতি, দার্শনিক এবং মানবতাবাদী। তাঁর জীবনের একদিকে যেমন ছিল ধ্বংসাত্মক শক্তি—ডাইনামাইট আবিষ্কারের ইতিহাস, অন্যদিকে ছিল বিশ্বশান্তির প্রতীক—নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের মহান দৃষ্টান্ত।

জন্ম ও শৈশব

আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর, সুইডেনের স্টকহোম শহরে। তাঁর পিতা ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন একজন প্রকৌশলী ও উদ্ভাবক, যিনি বিস্ফোরক ও মাইন তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। মা অ্যান্ড্রিয়েটা নোবেল ছিলেন গৃহিণী।

ছোটবেলা থেকেই নোবেলের মধ্যে ছিল বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও সাহিত্যপ্রেম। তিনি কবিতা লিখতেন এবং রসায়ন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।

শিক্ষাজীবন ও বৈজ্ঞানিক প্রস্তুতি

আলফ্রেড নোবেল সুইডেন, রাশিয়া এবং পরে জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত রসায়নবিদ নিকোলে জুলিও এবং গে-লুসাক

তিনি শেখেন:

  • রসায়ন ও বিস্ফোরক বিজ্ঞান
  • ধাতব প্রকৌশল
  • সাহিত্য ও দর্শন

● ভাষা দক্ষতা:

তিনি ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ ও সুইডিশসহ ৫টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন

আবিষ্কারে যাত্রা : বিস্ফোরকের নিয়ন্ত্রণ

নোবেল যখন পিতার কারখানায় কাজ শুরু করেন, তখন বিস্ফোরক পদার্থ হিসেবে নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহৃত হতো। এটি ছিল খুবই বিপজ্জনক এবং অস্থির।

১৮৬৪ সালে এক বিস্ফোরণে তাঁর ছোট ভাই এমিল নোবেল মারা যান। এই দুর্ঘটনা নোবেলকে নতুন ও নিরাপদ বিস্ফোরক তৈরির পথে পরিচালিত করে।

ডাইনামাইটের আবিষ্কার

আলফ্রেড নোবেল ১৮৬৭ সালে আবিষ্কার করেন ডাইনামাইট (Dynamite)—এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত শক্তির বিস্ফোরক, যেখানে নাইট্রোগ্লিসারিন শোষণ করা হয় ডায়াটোমাস আর্থে

● বৈশিষ্ট্য:

  • তুলনামূলকভাবে নিরাপদ
  • পরিবহণযোগ্য
  • খনন, নির্মাণ ও রেলপথে ব্যবহারযোগ্য

ডাইনামাইট দ্রুত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং শিল্পায়নে বিপ্লব ঘটায়।

শিল্প ও প্রযুক্তির অগ্রদূত

নোবেল তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করেন ৯০টির বেশি কারখানা ও গবেষণাগার। তিনি প্রায় ৩৫৫টি পেটেন্ট গ্রহণ করেন, যার মধ্যে রয়েছে—

  • ডেটোনেটর বা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র
  • জেলিগান পাউডার (আরও উন্নত বিস্ফোরক)
  • কৃত্রিম রবার ও চামড়া সংক্রান্ত প্রযুক্তি

● তাঁর কোম্পানিগুলো আজও ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে আছে।

বিতর্ক ও আত্মপোলব্ধি

নোবেলের আবিষ্কৃত ডাইনামাইট যখন সামরিক অস্ত্রে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, তখন তাঁকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্ক শুরু হয়। ১৮৮৮ সালে তাঁর ভাই লুডভিগের মৃত্যুর সময় এক ফরাসি সংবাদপত্র ভুলবশত শিরোনাম করে:

“The Merchant of Death is Dead.”
(মৃত্যুর ব্যবসায়ী মারা গেছে)

এই শিরোনাম নোবেলকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি আত্মপোলব্ধি করেন—তাঁর আবিষ্কার মানবতা ধ্বংসের চেয়ে কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া উচিত।

 

নিচে “আলফ্রেড নোবেল : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ” প্রবন্ধের দ্বিতীয় ও শেষ অংশ উপস্থাপন করা হলো। এতে রয়েছে তাঁর দার্শনিক মনোভঙ্গি, নোবেল পুরস্কারের সূচনা, মৃত্যুবরণ ও উত্তরাধিকার।

ব্যক্তিজীবন ও দর্শনচিন্তা

আলফ্রেড নোবেল ছিলেন অত্যন্ত একাকী, গম্ভীর ও অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। তিনি কোনোদিন বিয়ে করেননি। জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান গবেষণাগার, ভ্রমণ ও চিন্তাধারায় নিমগ্ন হয়ে।

● সাহিত্যপ্রেমী বিজ্ঞানী

তিনি নাটক ও কবিতা লিখতেন, অনুবাদ করতেন দর্শনগ্রন্থ। তাঁর লেখা “Nemesis” নামক নাটক নিষিদ্ধ হয়েছিল প্রচণ্ড বিতর্কের কারণে।

তিনি একসময় বলেছিলেন:

“If I have a thousand ideas and only one turns out to be good, I am satisfied.”

নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন

নোবেলের মৃত্যুর আগে, ১৮৯৫ সালে তিনি তাঁর সম্পত্তির প্রায় ৯৪% একটি ফাউন্ডেশনের নামে উইল করে যান।

● উদ্দেশ্য ছিল:

“যাতে প্রতিবছর মানবজাতির উপকারে আসা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা, সাহিত্য ও শান্তি প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করা যায়।”

এই উইলের ভিত্তিতে ১৯০১ সাল থেকে চালু হয় “নোবেল পুরস্কার”

নোবেল পুরস্কারের শাখাসমূহ

প্রথম দিকে পুরস্কার প্রদান করা হতো ৫টি শাখায়:

  1. ভৌতবিজ্ঞান (Physics)
  2. রসায়ন (Chemistry)
  3. চিকিৎসা/ফিজিওলজি (Medicine)
  4. সাহিত্য (Literature)
  5. শান্তি (Peace)

পরে ১৯৬৯ সালে যোগ হয়: 6. অর্থনীতি (Economics) – সুইডিশ ন্যাশনাল ব্যাংকের অনুদানে

● নোবেল পুরস্কার বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি।

মৃত্যুবরণ ও স্মরণ

আলফ্রেড নোবেল ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর, ইতালির সান রেমো শহরে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
তাঁকে সমাহিত করা হয় স্টকহোমে তাঁর পরিবারের কবরস্থানে।

উত্তরাধিকার ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা

আলফ্রেড নোবেল শুধু বিজ্ঞানী নন, একজন নীতিনিষ্ঠ মানবপ্রেমী। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো:

নিজের ধ্বংসাত্মক আবিষ্কারের ভারসাম্য রক্ষায় মানবকল্যাণের পথে ধন্য পদক্ষেপ—নোবেল পুরস্কার।

● বিশ্বজুড়ে তাঁর প্রভাব:

  • মানবাধিকার রক্ষায় উৎসাহ
  • শান্তি ও জ্ঞানের প্রসার
  • বৈজ্ঞানিক গবেষণার গতি বৃদ্ধি
  • তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশে অনুপ্রেরণা

উপসংহার

আলফ্রেড নোবেলের জীবন এক অদ্ভুত দ্বৈততার প্রতীক। একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তি—অন্যদিকে আত্মপোলব্ধি ও মানবিক বিবেকের জাগরণ। তাঁর জীবন থেকেই আমরা শিখি—

“আবিষ্কার যদি নৈতিকতা না জানে, তবে তা মানবজাতির জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়।”

নোবেল তাঁর কর্মের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছেন—যেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি একই সুতোয় গাঁথা হয়। আজ তাঁর নাম কেবল স্মরণীয় নয়—মানবজাতির আশা ও সম্ভাবনার অনন্ত প্রতীক।

https://www.munshiacademy.com/আলফ্রেড-নোবেল-আবিষ্কার-ও/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *