স্টিফেন হকিং : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

Spread the love

স্টিফেন হকিং : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

 

ভূমিকা

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা বিজ্ঞানের বাইরে গিয়েও মানবিকতা, সাহস ও বুদ্ধির এক প্রতীক হয়ে উঠেছেন। স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking) তাঁদের অন্যতম।
যিনি ALS নামক একটি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে চলাফেরা, কথা বলা এমনকি নড়াচড়া করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছিলেন—তবু তাঁর চিন্তা ছুঁয়ে গেছে মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্যকে।

তিনি ছিলেন একজন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক বুদ্ধিজীবী, ব্ল্যাক হোল, বিগ ব্যাং ও সময়ের প্রকৃতি নিয়ে মৌলিক তত্ত্ব প্রদানকারী, এবং বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এক অসাধারণ প্রেরণাদায়ী প্রতিভা।

জন্ম ও শৈশব

স্টিফেন হকিং জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে। এটি ছিল গ্যালিলিও গ্যালিলির মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পূর্তি দিবস, যা ভবিষ্যতের এক বিস্ময়কর মিল হয়ে রইল।

তাঁর বাবা ফ্র্যাঙ্ক হকিং ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানী এবং মা ইসোবেল হকিং ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও বইপ্রেমী। পরিবারটি ছিল বিদ্যাচর্চাপ্রবণ হলেও আর্থিকভাবে মধ্যবিত্ত। শৈশবে স্টিফেনের আগ্রহ ছিল গণিত, পদার্থ ও মহাকাশবিজ্ঞানে। খেলাধুলায় না জড়ালেও তিনি মেকানিক্যাল জিনিস খোলা-জোড়া করা পছন্দ করতেন।

শিক্ষাজীবন

স্টিফেন হকিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং স্নাতক শেষে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোসমোলজি বা মহাবিশ্ববিদ্যা বিষয়ে গবেষণায় অংশ নেন।

এ সময় তিনি জানতে পারেন, তিনি Amyotrophic Lateral Sclerosis (ALS) নামক এক বিরল স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত।

● ALS রোগ ও জীবনের বাঁক পরিবর্তন

এই রোগ ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রকে অকার্যকর করে ফেলে। চিকিৎসকরা বলেন—তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। কিন্তু হকিং দমে যাননি।
চাকরি, বিয়ে, সন্তান, গবেষণা—সবই চালিয়ে যান প্রযুক্তির সাহায্যে।
এক সময় তাঁর দেহ পুরোপুরি অচল হয়ে যায়, তিনি কেবল গাল হালকা নাড়াতে পারতেন, সেখান থেকেই সংযোগ হতো কৃত্রিম কণ্ঠস্বর যন্ত্রের সঙ্গে।

ব্ল্যাক হোল তত্ত্বে মৌলিক অবদান

স্টিফেন হকিং-এর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অবদান হলো—ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত তত্ত্ব

● হকিং রেডিয়েশন (Hawking Radiation)

তিনি ১৯৭৪ সালে প্রমাণ করেন—

ব্ল্যাক হোল শুধু বস্তু গ্রাস করে না, বরং আণবিক কণা বিকিরণ করে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে পারে।

এই বিকিরণ আজ পরিচিত “Hawking Radiation” নামে। এই তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিকতাবাদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করে।

বিগ ব্যাং ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

স্টিফেন হকিং বলেন—মহাবিশ্বের একটি সূচনা ছিল এবং সেটি ছিল বিগ ব্যাং নামক এক অতি ঘনীভূত বিন্দু থেকে শুরু। তাঁর লেখা The Universe in a Nutshell এবং A Brief History of Time বইয়ে এই ধারণাগুলোর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

তিনি যুক্তি দেন—সময় ও স্থান একে অপরের সঙ্গে যুক্ত এবং মহাবিশ্বের সূচনায় সময়ও শুরু হয়েছে। সুতরাং “মহাবিশ্বের আগে কিছু ছিল না”—এই ধারণাই বিজ্ঞানের পরিভাষায় সঠিক।

জনপ্রিয় গ্রন্থাবলি : বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া

স্টিফেন হকিং শুধু বিজ্ঞান গবেষণায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি সাধারণ মানুষের কাছে জটিল তত্ত্বগুলো সহজ করে উপস্থাপন করেছিলেন।

● A Brief History of Time (১৯৮৮)

তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই, যেখানে মহাবিশ্ব, সময়, বিগ ব্যাং, ব্ল্যাক হোল, আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম তত্ত্ব সবই অসাধারণ সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বইটি ২০০ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বেস্টসেলার তালিকায় ছিল এবং অনূদিত হয়েছে ৪০টির বেশি ভাষায়।

● The Universe in a Nutshell

● Black Holes and Baby Universes

● The Grand Design

● Brief Answers to the Big Questions

এই বইগুলোতে বিজ্ঞান ও দর্শনের দারুণ সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন—

“বিজ্ঞান শুধু গবেষণাগারের জন্য নয়, তা মানব জীবনের পথপ্রদর্শক।”

বিজ্ঞান প্রচারে ভূমিকা ও সমাজচিন্তা

স্টিফেন হকিং ছিলেন একজন বিজ্ঞানপ্রচারক ও জনবুদ্ধিজীবী

  • তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রাম, ডকুমেন্টারি ও বক্তৃতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞান বুঝতে সাহায্য করেন।
  • তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে যুক্তিপূর্ণ বিতর্কে অংশ নেন এবং বলেন:

    “I believe the universe is governed by the laws of science. The laws may have been decreed by God, but God does not intervene.”

  • তিনি পরিবেশ সঙ্কট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশে বসতি গড়ার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়েও চিন্তা প্রকাশ করেন।

প্রযুক্তি নির্ভরতা ও মানুষের সাহসিকতার প্রতীক

স্টিফেন হকিং আধুনিক প্রযুক্তির উপর নির্ভর করেই তাঁর চিন্তাশক্তিকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।

● কম্পিউটারভিত্তিক ভয়েস সিন্থেসাইজার

১৯৮৫ সালে এক অস্ত্রোপচারের পর তিনি বাকশক্তি হারান। এরপর থেকে তাঁর কণ্ঠ হয়ে ওঠে একটি কৃত্রিম যন্ত্র

তিনি গাল হালকা নাড়িয়ে টাইপ করতেন, আর সেই অনুযায়ী যন্ত্র কণ্ঠে অনুবাদ করত।

এই প্রযুক্তি তাঁকে গবেষণা, লেখালেখি, বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।

মৃত্যুবরণ ও বিজ্ঞান সমাজের শোক

স্টিফেন হকিং ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ কেমব্রিজে মৃত্যুবরণ করেন। এটি ছিল আবারও এক ঐতিহাসিক মিল—আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিনেই তিনি মারা যান।

● শেষকৃত্যে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদেরা অংশ নেন।

তাঁর দেহাবশেষ কবর দেওয়া হয় আইজ্যাক নিউটন ও চার্লস ডারউইনের কবরের পাশে—ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে।

এ যেন বিজ্ঞানের তিন বিশাল স্তম্ভের একসঙ্গে অবস্থান।

উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন

স্টিফেন হকিং-এর অবদান শুধু ব্ল্যাক হোল বা কোসমোলজি নয়, বরং—

  • মানবিক প্রেরণা,
  • বিজ্ঞানমনস্কতা,
  • প্রযুক্তির ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং
  • জীবনের অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক জীবন্ত উদাহরণ।

● তাঁর অবদান:

শাখা অবদান
জ্যোতির্বিজ্ঞান ব্ল্যাক হোল তত্ত্ব, কসমোলজি
পদার্থবিজ্ঞান কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি, সময়ের প্রকৃতি
বিজ্ঞান প্রসার ‘A Brief History of Time’, মিডিয়া অংশগ্রহণ
প্রতিবন্ধকতা জয় প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপন ও গবেষণা অব্যাহত রাখা

উপসংহার

স্টিফেন হকিং প্রমাণ করেছেন—দেহের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মনের সম্ভাবনার কোনো সীমানা নেই। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, দার্শনিক, লেখক, যোদ্ধা এবং মানুষের আত্মশক্তির প্রতীক।

তাঁর জীবন আমাদের শিখিয়েছে—

“While there’s life, there’s hope.”
আর তাঁর কর্ম আমাদের বলে—
“Look up at the stars and not down at your feet.”

স্টিফেন হকিং আজ নেই, কিন্তু তাঁর গবেষণা, বই, চিন্তাধারা এবং জীবনদর্শন আমাদের বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও মানবতার পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে।

https://www.munshiacademy.com/স্টিফেন-হকিং-আবিষ্কার-ও-ক/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *