চার্লস ডারউইন : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

Spread the love

চার্লস ডারউইন : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

 

ভূমিকা

জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে যা মানবজাতির চিন্তাজগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তেমনি একজন মনীষী হলেন চার্লস রবার্ট ডারউইন (Charles Darwin), যিনি “প্রাকৃতিক নির্বাচন”-এর মাধ্যমে জীবজগতের বিবর্তন ব্যাখ্যা করে মানুষের অস্তিত্ব ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনকারী এবং এক গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের অগ্রপথিক।

জন্ম ও শৈশব

চার্লস ডারউইন জন্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ইংল্যান্ডের শ্রুসবেরি নামক শহরে। তাঁর পিতা রবার্ট ডারউইন ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা সুজানা ওয়েজউড ছিলেন ধনী ও সংস্কৃতিবান পরিবার থেকে আগত। ডারউইনের পরিবার ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে গড়ে ওঠা, এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে আগ্রহী ছিলেন।

শৈশবে তিনি গাছপালা, পোকামাকড়, পাখি সংগ্রহ করতেন এবং নিজে নিজে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। এই আগ্রহই তাঁকে ভবিষ্যতের দার্শনিক জীববিজ্ঞানীর দিকে ধাবিত করে।

শিক্ষাজীবন

ডারউইনের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার পর তাঁকে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার জন্য এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু অস্ত্রোপচারের রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে তিনি চলে যান ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখান থেকে তিনি ধর্মতত্ত্বে ডিগ্রি অর্জন করেন।

তবে মূলত প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, ভূতত্ত্ব, প্রাণীজগৎ—এইসব বিষয়েই ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। ক্যামব্রিজে অধ্যয়নকালে তিনি উদ্ভিদবিদ জন স্টিভেনস হেনসলোর সংস্পর্শে আসেন, যিনি তাঁর জীবনের অন্যতম গুরু হয়ে ওঠেন।

এইচ.এম.এস বিগল জাহাজে ভ্রমণ (১৮৩১–১৮৩৬)

ডারউইনের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় যখন তিনি এইচএমএস বিগল (HMS Beagle) নামক ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক জরিপ জাহাজে প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ হিসেবে বিশ্বভ্রমণে বের হন। ভ্রমণকাল: ২৭ ডিসেম্বর ১৮৩১ – ২ অক্টোবর ১৮৩৬

এই পাঁচ বছরের বিশ্বভ্রমণে ডারউইন নানা ভূখণ্ডের প্রাণিজ ও উদ্ভিদজগত, ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং আদিবাসীদের জীবনযাপন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করেন। বিশেষ করে তিনি যা দেখেন—

● গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের জীবজগত

ডারউইন লক্ষ্য করেন—একই প্রজাতির পাখি (যেমন ফিঞ্চ) বিভিন্ন দ্বীপে ভিন্ন খাদ্যভ্যাস ও ঠোঁটের আকার অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণই তাঁকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা দিতে শুরু করে।

● দক্ষিণ আমেরিকার ফসিল

তিনি দেখেন—বর্তমানে জীবিত কিছু প্রাণীর পূর্বপুরুষের জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ জীবজগতে ধারাবাহিক রূপান্তর ঘটছে।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব (Theory of Natural Selection)

ডারউইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৈপ্লবিক আবিষ্কার হলো—প্রাকৃতিক নির্বাচন। তিনি বলেন:

প্রকৃতিতে সব জীব অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে, এবং যেসব জীব পরিবেশের সঙ্গে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তারাই টিকে থাকে ও বংশবিস্তার করে।

প্রধান উপাদানসমূহ:

  1. উৎপাদন ক্ষমতা বেশি: সব প্রাণীই বেশি সন্তান জন্ম দেয়
  2. পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা: খাদ্য ও আশ্রয়ের সীমাবদ্ধতা
  3. বৈচিত্র্য: এক প্রজাতির মধ্যেও বৈচিত্র্য দেখা যায়
  4. যারা খাপ খাওয়াতে পারে তারা বেঁচে থাকেSurvival of the Fittest

এই নির্বাচনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রজাতির পরিবর্তন হয় এবং নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে।

বিবর্তনবাদ বনাম সৃষ্টিতত্ত্ব

ডারউইনের তত্ত্ব সরাসরি ধর্মীয় বিশ্বাস ও বাইবেলীয় সৃষ্টিতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে। বাইবেল অনুসারে, ঈশ্বর ছয় দিনে পৃথক পৃথক প্রাণীর সৃষ্টি করেন। কিন্তু ডারউইন বলেন—সব প্রাণীই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়েছে।

এই ধারণা খ্রিস্টান সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, কারণ এতে ঈশ্বরকেন্দ্রিক সৃষ্টির ধারণা ক্ষুণ্ন হয়। বহু ধর্মযাজক ও রক্ষণশীল সমাজ তাঁর তত্ত্বকে ‘ব্লাসফেমি’ বলে নিন্দা করেন।

‘The Origin of Species’ : একটি বৈপ্লবিক গ্রন্থ

১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত বই — “On the Origin of Species by Means of Natural Selection”

এই বইটি প্রথমবারের মতো যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনার মাধ্যমে জীবজগতের বিবর্তন ব্যাখ্যা করে। এতে তিনি বলেন:

“All species of life have descended over time from common ancestors.”

এই বইয়ের প্রভাব তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘস্থায়ী:

  • বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন তোলে
  • জীববিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা ও জিনবিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা করে
  • জনমানসে নতুন প্রশ্ন তোলে: মানুষ কোথা থেকে এসেছে?

মানবজাতি ও বিবর্তন : ‘The Descent of Man’

১৮৭১ সালে ডারউইন প্রকাশ করেন তাঁর আরেকটি যুগান্তকারী গ্রন্থ —
📘 “The Descent of Man, and Selection in Relation to Sex”

এই বইয়ে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন—

মানুষ এবং বানর একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে।

এটি তখনকার সমাজে চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ মানুষকে “ঈশ্বরের প্রতিনিধি” না বলে “বিবর্তনের ফল” বলা হলে ধর্মীয় গোঁড়ামির ভীত নড়ে ওঠে।

তবে ডারউইন বলেননি যে মানুষ বানর থেকে এসেছে, বরং তিনি বলেছিলেন—মানুষ ও বানরের মধ্যে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল। এ ছিল এক বৈপ্লবিক ব্যাখ্যা, যা আজও জৈববিজ্ঞানের ভিত্তিমূল।

অন্যান্য গবেষণা ও গ্রন্থ

ডারউইনের গবেষণা শুধু বিবর্তনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণীর আচরণ, প্রজনন প্রক্রিয়া, মৌমাছি, অর্কিড, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি নিয়েও বিস্তৃত গবেষণা করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ:

  • “The Expression of the Emotions in Man and Animals” (১৮৭২) — মানুষের মুখাবয়ব ও প্রাণীর আচরণের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
  • “The Power of Movement in Plants” (১৮৮০) — উদ্ভিদের গতি ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা।
  • “Insectivorous Plants” (১৮৭৫) — কীটভুক উদ্ভিদের আচরণ নিয়ে ব্যাখ্যা।

এইসব রচনায় দেখা যায়—ডারউইন ছিলেন এক গভীর পর্যবেক্ষণশীল ও নানামাত্রিক গবেষক।

সমালোচনা ও বিরোধিতা

ডারউইনের তত্ত্ব প্রকাশের পর নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

● ধর্মীয় বিরোধিতা

বিশেষ করে খ্রিস্টান চার্চ ও ধর্মতাত্ত্বিকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাঁরা বলেন—

  • এটি ঈশ্বরের সৃষ্টি তত্ত্বকে অস্বীকার করে।
  • মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে।

● বৈজ্ঞানিক বিতর্ক

ডারউইনের সময় জিন ও ডিএনএ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না, তাই অনেক বিজ্ঞানী তাঁর ‘নির্বাচনের প্রক্রিয়া’কে অসম্পূর্ণ বলেও অভিহিত করেন।

তবে পরবর্তীতে গ্রেগর মেনডেলের জিনতত্ত্ব এবং আধুনিক মলিকিউলার বায়োলজি বিবর্তনবাদকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে।

সমর্থন ও পুনর্মূল্যায়ন

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডারউইনের তত্ত্ব বিজ্ঞানী সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে। জৈববিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক্স প্রভৃতি শাখা তাঁর ধারণাকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

উল্লেখযোগ্য সমর্থকরা:

  • টমাস হাক্সলি: “Darwin’s Bulldog” নামে পরিচিত, যিনি বিবর্তনবাদ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
  • আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস: যিনি ডারউইনের সঙ্গে সমান্তরালে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা দিয়েছিলেন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

চার্লস ডারউইন ১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ডাউন গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে আইজ্যাক নিউটনের পাশেই সমাহিত করা হয়, যা তাঁর বৈজ্ঞানিক মর্যাদার স্বীকৃতি বহন করে।

তাঁর মৃত্যুর পর বিজ্ঞানী মহল ও সমাজে তাঁকে মানব সভ্যতার অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মূল্যায়ন ও প্রভাব

চার্লস ডারউইনের অবদান কেবল জৈববিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি মানুষের আত্মপরিচয়, ধর্ম, সমাজ ও দর্শনকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন।

● আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভিত্তি

ডারউইনের তত্ত্ব ছাড়া জেনেটিক্স, ইকোলজি, নিউরোসায়েন্সসহ বহু শাখা অস্পষ্ট থেকে যেত।

● ধর্ম-বিজ্ঞান সংলাপ

তাঁর তত্ত্ব ধর্মীয় চিন্তাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। এতে অন্ধবিশ্বাস নয়, যুক্তি ও অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

● নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞান

মানবজাতির উদ্ভব ও সমাজ বিবর্তনের ব্যাখ্যায় ডারউইনের চিন্তাধারা আজও প্রাসঙ্গিক।

উপসংহার

চার্লস ডারউইন ছিলেন বিজ্ঞান ইতিহাসের এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী মনীষী, যিনি সাহসিকতা, যুক্তিবাদ ও অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যতম জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেছেন—“আমরা কোথা থেকে এসেছি?”

তাঁর জীবন ও কর্ম প্রমাণ করে—প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, ধৈর্য ও যুক্তি একত্রে মানুষকে কত দূর নিয়ে যেতে পারে। বিবর্তন তত্ত্ব কেবল বিজ্ঞানের নয়, মানবসমাজের জ্ঞান-বুদ্ধির ইতিহাসের একটি মাইলফলক।

ডারউইন আজ জীবিত নন, কিন্তু তাঁর তত্ত্ব, চিন্তাধারা ও অবদান চিরকাল বিজ্ঞানের বাতিঘর হয়ে থাকবে।

https://www.munshiacademy.com/চার্লস-ডারউইন-আবিষ্কার-ও/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *