চার্লস ল্যাম্ব : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love
Charles_Lamb
Charles_Lamb

চার্লস ল্যাম্ব : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

১. ভূমিকা

চার্লস ল্যাম্ব (১০ ফেব্রুয়ারি ১৭৭৫ – ২৭ ডিসেম্বর ১৮৩৪) ছিলেন ইংরেজ সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান প্রবন্ধকার, কবি এবং শিশুসাহিত্যিক। তাঁর সাহিত্যকর্মে আত্মজৈবনিক অনুভব, অন্তরঙ্গতা ও রসিকতার সংমিশ্রণে এক স্বতন্ত্র লেখনীর ধারা সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন “Essays of Elia” ও “Tales from Shakespeare”-এর জন্য। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে গভীর মানবিকতা, আত্ম-অনুভব, ব্যঙ্গরস ও দার্শনিক উপলব্ধি অনুপমভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

২. শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

চার্লস ল্যাম্ব লন্ডনের ইননার টেম্পল-এর ক্রাউন অফিস রো-তে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জন ল্যাম্ব একজন আইনজীবীর সহকারী ছিলেন এবং মাতা এলিজাবেথ ছিলেন একজন গৃহিণী। চার্লসের একটি ভাই ও একটি বোন ছিল, যার মধ্যে বড় বোন মেরি ল্যাম্ব তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি সংবেদনশীল, বইপ্রেমী ও চিন্তাশীল ছিলেন।

৩. শিক্ষা জীবন

চার্লস ল্যাম্ব Christ’s Hospital স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তাঁর সঙ্গে কবি স্যামুয়েল টেলর কলরিজ-এর বন্ধুত্ব হয়। এখানেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ গড়ে ওঠে। স্কুলের কঠোর পরিবেশ তাঁকে মননশীল করে তোলে, যা পরবর্তীকালে তাঁর প্রবন্ধে প্রতিফলিত হয়। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

৪. চাকরি ও জীবনের সংকট

১৭৯২ সালে ল্যাম্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির East India House-এ একটি কেরানির পদে চাকরি গ্রহণ করেন এবং সেখানেই টানা ৩৩ বছর কাজ করেন। ১৭৯৬ সালে তাঁর বোন মেরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মা-কে হত্যা করেন। চার্লস তখন নিজেই বোনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করান। আজীবন তিনি বোনের দেখভাল করেন। এই পারিবারিক সংকট তাঁর লেখার আবেগময় গভীরতায় প্রতিফলিত হয়েছে।

৫. সাহিত্যকর্ম

৫.১ প্রবন্ধ

চার্লস ল্যাম্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো “Essays of Elia” (১৮২৩) ও “Last Essays of Elia” (১৮৩৩)। Elia ছদ্মনামে প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলিতে শহুরে জীবন, পুরনো লন্ডনের স্মৃতি, শৈশব, বন্ধুত্ব, স্বপ্ন, বিষাদ, এবং হাস্যরস সব কিছুই স্থান পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • Dream Children: A Reverie – যেখানে তিনি বাস্তব জীবনের শূন্যতা ও একটি কাল্পনিক সংসারের ব্যথাময় চিত্র আঁকেন।
  • The Praise of Chimney Sweepers – সমাজের অবহেলিত শিশু শ্রমিকদের প্রতি এক আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ পায়।
  • A Dissertation Upon Roast Pig – রসাত্মক রচনার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

ল্যাম্বের প্রবন্ধের ভাষা সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ও সংবেদনশীল। প্রবন্ধে আত্মজৈবনিক ভঙ্গি, রসবোধ ও দার্শনিক মনোভাবের মিলন তাঁকে ইংরেজ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধকারদের একজন করে তুলেছে।

৫.২ শিশুসাহিত্য

১৮০৭ সালে ল্যাম্ব ও তাঁর বোন মেরি যৌথভাবে “Tales from Shakespeare” রচনা করেন, যেখানে শেক্সপিয়ারের নাটকসমূহকে সহজ ভাষায় শিশুদের জন্য রূপান্তর করা হয়। চার্লস ট্র্যাজেডি অংশগুলো আর মেরি কমেডিগুলো রূপান্তর করেন। এই বই আজও শিশুদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।

৫.৩ কবিতা

যদিও ল্যাম্ব মূলত প্রবন্ধকার হিসেবে খ্যাত, তবুও তিনি কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতাও রচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় বিষাদ, স্মৃতি ও কল্পনার নিপুণ সংমিশ্রণ দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য কবিতা:

  • The Old Familiar Faces
  • On an Infant Dying as Soon as It Was Born

৫.৪ নাট্যসমালোচনা

তিনি “Specimens of English Dramatic Poets Who Lived About the Time of Shakespeare” (১৮০৮) নামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন, যেখানে সমসাময়িক নাট্যকারদের রচনার মূল্যায়ন করা হয়েছে। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডিগুলোর উপর তাঁর বিশ্লেষণ আজও নাট্যসমালোচনায় মূল্যবান।

৬. বন্ধুত্ব ও সাহিত্যচর্চা

চার্লস ল্যাম্ব ছিলেন স্যামুয়েল টেলর কলরিজ, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, উইলিয়াম হ্যাজলিট, লি হান্ট প্রমুখ কবি-লেখকদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরা নিয়মিতভাবে সাহিত্য আলোচনায় মিলিত হতেন, যা সাহিত্যাঙ্গণে “ল্যাম্ব সার্কেল” নামে পরিচিত।

৭. ব্যর্থ প্রেম ও নিঃসঙ্গতা

চার্লস ল্যাম্ব কখনো বিবাহ করেননি। ১৮১৯ সালে তিনি অভিনেত্রী ফ্যানি কেলিকে বিবাহ প্রস্তাব দেন, তবে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর তিনি বোনের সঙ্গেই জীবন কাটিয়ে দেন। প্রেমের এই ব্যর্থতা ও নিঃসঙ্গতা তাঁর লেখায় আবেগঘন রূপ পেয়েছে।

৮. ভাষা ও শৈলী

ল্যাম্বের লেখার ভাষা সহজ, কথ্যভাষার ধাঁচে, কিন্তু তাতে সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও কাব্যিকতা ছিল। তাঁর রচনায় পুরোনো ইংরেজি শব্দ ও অলংকারের ব্যবহার লক্ষণীয়। প্রবন্ধে হাস্য, ব্যঙ্গ, বিষাদ, স্মৃতি ও সৌন্দর্য মিশে এক অপূর্ব রসঘন আবহ সৃষ্টি করে।

৯. মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৮৩৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে ছিলেন বোন মেরি, যিনি তখন মানসিক হাসপাতালে ছিলেন। তাঁকে এডমন্টনে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পর তাঁর লেখা, বিশেষ করে “Essays of Elia”, তাঁকে ইংরেজ সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখে।

১০. মূল্যায়ন

চার্লস ল্যাম্বের সাহিত্যকর্ম আজও ইংরেজ সাহিত্যের ছাত্রদের পাঠ্য। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন অকপটভাবে। তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় আছে প্রেম, বেদনা, হাস্যরস, দার্শনিকতা ও মানবিকতা। সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি একমাত্রিক নন; বরং বহুমাত্রিক এক শিল্পস্রষ্টা।

১১. উপসংহার

চার্লস ল্যাম্ব ছিলেন এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যিনি জীবনের সাধারণ ঘটনা ও অনুভূতিকে শিল্পের স্তরে উন্নীত করেছিলেন। তাঁর লেখায় আত্মপ্রকাশ, মানবতা, দুঃখবোধ, স্মৃতি ও কল্পনার যে নিপুণ সংমিশ্রণ দেখা যায়, তা আজও পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করে। চার্লস ল্যাম্ব শুধু একজন প্রবন্ধকার নন—তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ প্রেমিক, একজন আত্মত্যাগী ভাই, একজন কাব্যিক অনুভূতির অধিকারী মানবিক লেখক।

https://www.munshiacademy.com/চার্লস-ল্যাম্ব-জীবন-ও-সাহ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *