ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

Spread the love

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯

শামসুর রহমান

এখানে এসেছি কেন? এখানে কি কাজ আমাদের?
এখানে তো বোনাস ভাউচারের খেলা নেই কিম্বা নেই মায়া
কোনো গোল টেবিলের, শাসনতন্ত্রের ভেলকিবাজি,
সিনেমার রঙিন টিকিট
নেই, নেই সার্কাসের নিরীহ অসুস্থ বাঘ, কসরৎ দেখানো
তরুণীর শরীরের ঝলকানি নেই কিম্বা ফানুস ওড়ানো
তা-ও নেই, তবু কেন এখানে জমাই ভিড় আমরা সবাই?
আমি দূর পলাশতলীর
হাড্‌ডিসার ক্লান্ত এক ফতুর কৃষক,
বধ্যযুগী বিবর্ণ পটের মতো ধু-ধু,
আমি মেঘনার মাঝি, ঝড় বাদলের
নিত্য-সহচর,
আমি চটকলের শ্রমিক,
আমি মৃত রমাকান্ত কামারের নয়ন পুত্তলি,
আমি মাটিলেপা উঠোনের
উদাস কুমোর, প্রায় ক্ষ্যাপা, গ্রাম উজাড়ের সাক্ষী,
আমি তাঁতি সঙ্গীহীন, কখনো পড়িনি ফার্সি, বুনেছি কাপড় মোটা-মিহি
মিশিয়ে মৈত্রীর ধ্যান তাঁতে,
আমি
রাজস্ব দফতরের করুণ কেরানি, মাছি-মারা তাড়া-খাওয়া,
আমি ছাত্র, উজ্জ্বল তরুণ,
আমি নব্য কালের লেখক,
আমার হৃদয়ে চর্যাপদের হরিণী
নিত্য করে আসা-যাওয়া, আমার মননে
রাবীন্দ্রিক ধ্যান জাগে নতুন বিন্যাসে
এবং মেলাই তাকে বাস্তবের তুমুল রোদ্দুরে
আর চৈতন্যের নীলে কতো স্বপ্ন-হাঁস ভাসে নাক্ষত্রিক স্পন্দনে সর্বদা।
আমরা সবাই
এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?
কোন সে জোয়ার
করেছে নিক্ষেপ আমাদের এখন এখানে এই
ফাল্গুনের রোদে? বুঝি জীবনেরই ডাকে
বাহিরকে আমরা করেছি ঘর, ঘরকে বাহির।
জীবন মানেই
মাথলা মাথায় মাঠে ঝাঁ ঝাঁ রোদে লাঙল চালানো,
জীবন মানেই
ফসলের গুচ্ছ বুকে নিবিড় জড়ানো,
জীবন মানেই
মেঘনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে দাঁড় বাওয়া পাল খাটানো হাওয়ায়,
জীবন মানেই
পৌষের শীতার্ত রাতে আগুনে পোহানো নিরিবিলি।
জীবন মানেই
মুখ থেকে কারখানার কালি মুছে বাড়ি ফেরা একা শিস দিয়ে,
জীবন মানেই,
টেপির মায়ের জন্যে হাট থেকে ডুরে শাড়ি কেনা,
জীবন মানেই
বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়া, সহপাঠিনীর চুলে
অন্তরঙ্গ আলো তরঙ্গের খেলা দেখা,
জীবন মানেই
তালে তালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে চলা, নিশান ওড়ানো,
অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা,
জীবন মানেই
মায়ের প্রসন্ন কোলে মাথা রেখে শৈশবের নানা কথা ভাবা,
জীবন মানেই
খুকির নতুন ফ্রকে নকশা তোলা, চারু লেস বোনা,
জীবন মানেই
ভায়ের মুখের হাসি, বোনের নিপুণ চুল আঁচড়ানো,
জীবন মানেই
হাসপাতালের বেডে শুয়ে একা আরোগ্য ভাবনা,
জীবন মানেই
গলির মোড়ের কলে মুখ দিয়ে চুমুকে চুমুকে জলপান,
জীবন মানেই
রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়ানো,
স্ফুলিঙ্গের মতো সব ইস্তাহার বিলি করা আনাচে-কানাচে
জীবন মানেই…
আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরেথরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।
এ রঙের বিপরীত আছে অন্য রঙ,
যে রঙ লাগে না ভালো চোখে, যে-রঙ সন্ত্রাস আনে
প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়-
এখন সে-রঙে ছেয়ে গেছে পথঘাট, সারা দেশ
ঘাতকের অশুভ আস্তানা।
আমি আর আমার মতোই বহু লোক
রাত্রিদিন ভুলুণ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায়, কেউ মরা, আধমরা কেউ
কেউবা ভীষণ জেদী, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া।
চতুর্দিকে মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ।
বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই
জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনও বীরের রক্তে দুখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিং উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ || February 1969 || ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতা || ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতা hsc ||

https://youtu.be/hHtepa1c6hg?si=t9-O6Nzw_J8zdcrT

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *