ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love

 ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

**ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর** ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার, যিনি ১৮শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯শ শতকের প্রথম ভাগে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বাংলা নবজাগরণের পূর্ববর্তী সময়ের সাহিত্যিক ধারা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জন্ম ও শৈশব

ভারতচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বর্ধমান জেলার ভুরসুট পরগণার পান্ডুয়া গ্রামে ১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের ঔরসে ভবানী দেবীর গর্ভে চতুর্থ তথা কনিষ্ঠ সন্তান রূপে জন্মগ্রহণ করেন। জমির অধিকার সংক্রান্ত বিবাদ সূত্রে নরেন্দ্রনারায়ণ বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র রায়ের জননীকে কটূক্তি করায় রাজাজ্ঞায় বর্ধমানের সেনাপতি নরেন্দ্রনারায়ণের জমিদারি গ্রাস করে নিলে বাস্তুচ্যূত জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ পালিয়ে যান এবং ভারতচন্দ্র মণ্ডলঘাট পরগনার নওয়াপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে চলে আসেন।

শিক্ষা ও বিবাহ

মামা বাড়ির সন্নিহিত তাজপুর গ্রামের টোলে ব্যাকরণ ও অভিধান পাঠের মাধ্যমে তার বিদ্যাশিক্ষার শুরু। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় নরোত্তম আচার্যের কন্যার সারদার সঙ্গে। কেবলমাত্র সংস্কৃত শিক্ষা করেছেন বলে তাঁর বড় ভাইয়েরা ভর্ৎসনা করাতে, ভারতচন্দ্র হুগলী জেলার বাঁশবেড়িয়ার নিকট সরস্বতী নদী তীরবর্তী পশ্চিম দেবানন্দপুর গ্রামের রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে ফারসি ভাষা শেখেন। এ সময় সত্যনারায়ণ পূজা উপলক্ষে ১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাত্র পনেরো বছর বয়সে সত্যনারায়ণ পাঁচালী রচনা করেন। তার তিন পুত্রের নাম পরীক্ষিৎ, রামতনু ও ভগবান।

কারাবাস ও পলায়ন

ভারতচন্দ্র আত্মীয়দের পরামর্শে মোক্তার হিসেবে বর্ধমানে যান ও তাঁর পিতার ইজারা গৃহীত জমি দেখাশোনা করেন। কিন্তু তাঁর ভাইয়েরা নিয়মিত কর প্রেরণে অপারগ হলে বর্ধমানের রাজা ঐ জমিটি খাসভুক্ত করে নেন। এতে ভারতচন্দ্র আপত্তি করায় তাঁকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে কারা রক্ষকের দয়ায় তিনি গোপনে মারাঠা শাসিত কটকে পালিয়ে সুবেদার শিবভট্টর কাছে আশ্রয় লাভ করেন।

পুরীধামে বসবাস

ভারতচন্দ্র শিব ভট্টর কাছে নিজের সব ঘটনা খুলে বলেন ও পুরী ধামে কিছুদিন বাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দয়াশীল সুবেদার তাঁর কর্মচারী, মঠের আধিকারিক ও পাণ্ডাদের নির্দেশ দেন যে উনি যতদিন শ্রীক্ষেত্রে থাকতে চান, ততদিন ওনার কাছ থেকে যেন কোনরকম কর না চাওয়া হয় বা ওনার যখন যে মঠে ইচ্ছা উনি থাকতে পারবেন সেরকম ব্যবস্থা যেন করা হয়। ভারতচন্দ্র এবং ওনার ভৃত্যের আহারের জন্য প্রতিদিন একটি বলরামী আটকের ব্যবস্থাও করেন উনি।[৪]

 

সাহিত্যকর্ম

ভারতচন্দ্রের প্রধান কাব্য হলো **‘অন্নদামঙ্গল’**, যা তিন খণ্ডে বিভক্ত। এতে দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য, প্রেম কাহিনী এবং বীরত্ব বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি **‘সত্যপীরের পাঁচালি’**, **‘গঙ্গাষ্টক’**, **‘নাগষ্টক’** ও **‘রসমঞ্জরী’** রচনা করেন।

সাহিত্য বৈশিষ্ট্য

তার কবিতায় প্রাচীন সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। ছন্দের নিপুণ ব্যবহার ও অলংকারে তার কবিতা সমৃদ্ধ। অনেক পঙ্‌ক্তি আজও বাংলা প্রবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রভাব

ভারতচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষ এবং নবজাগরণের শুরু হিসেবে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কাজকে উচ্চমাত্রায় মূল্যায়ন করেন।

কবিতার শৈলী ও ভাষা

ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার ভাষার সরলতা এবং ছন্দের সুষমা। তিনি বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ও ফারসির প্রভাব থেকে মুক্ত করে তাকে আরও প্রাণবন্ত ও ছন্দোবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তাঁর কবিতা প্রচলিত সংস্কৃতিক কাব্যের ছন্দ ও অলংকারকে বাংলা ভাষায় প্রয়োগের মাধ্যমে এক স্বতন্ত্র শৈলী প্রতিষ্ঠা করে।

তিনি সংস্কৃত ও আরবি-ফার্সি শব্দের যথাযথ সমন্বয়ে একটি নিখুঁত ভাষাগত ভারসাম্য তৈরি করেছেন যা বাংলা কাব্যের স্বরূপকে সমৃদ্ধ করে।

প্রধান কবিতাসমূহ

১. অন্নদামঙ্গল

ভারতচন্দ্রের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত মহাকাব্য ‘অন্নদামঙ্গল’ তার প্রধান সৃষ্টি। এটি দেবী অন্নপূর্ণার মহিমা ও মহাকাব্যিক কাহিনী উপস্থাপন করে। ‘অন্নদামঙ্গল’-এর তিনটি খণ্ড — অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য, বিদ্যাসুন্দর প্রেমকাহিনী এবং ভবানন্দ-মানসিংহের বীরত্বগাথা— বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য অবদান।

২. সত্যপীরের পাঁচালি

এই কবিতায় ভারতচন্দ্র সত্যনারায়ণ দেবীর কাহিনী আবৃত্তি করেছেন যা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় সমৃদ্ধ।

৩. গঙ্গা-ষ্টক ও নাগ-ষ্টক

‘গঙ্গা-ষ্টক’ ও ‘নাগ-ষ্টক’ সংস্কৃত ভাষায় রচিত কবিতা, যেগুলোতে গঙ্গা নদী ও নাগ দেবতার মহিমা বর্ণিত হয়েছে।

কবিতার বিষয়বস্তু ও ভাবগভীরতা

ভারতচন্দ্রের কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতা গাঁথা। তাঁর কাব্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মানব জীবনের নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ। তিনি বাংলার লোক সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃত মহাকাব্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় আঞ্চলিক ঐতিহ্যের ছোঁয়া স্পষ্ট।

সাহিত্যিক গুরুত্ব ও প্রভাব

ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় কাব্যধারাকে নবজাগরণের পূর্বে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেন। তাঁর ভাষাশৈলী ও ছন্দপ্রয়োগ পরবর্তী কবিদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ নবজাগরণের কবিরা ভারতচন্দ্রের কাজকে উচ্চভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

উপসংহার

ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী কাব্যধারার অঙ্গ এবং তার সাহিত্যিক অবদান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। তাঁর কবিতার সরল ভাষা ও ছন্দের সুক্ষ্ম প্রয়োগ বাংলা কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে, যা আজও পাঠক হৃদয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

রেফারেন্স

 রেফারেন্স

* [বাংলাপিডিয়া: ভারতচন্দ্র রায়](https://bn.banglapedia.org/index.php?title=ভারতচন্দ্র_রায়)
* [উইকিপিডিয়া: ভারতচন্দ্র রায়](https://bn.wikipedia.org/wiki/ভারতচন্দ্র_রায়)
* [Roar বাংলা: ভারতচন্দ্র রায়](https://archive.roar.media/bangla/main/literature/bharat-chandra-ray-gunakar)

https://www.munshiacademy.com/ভারতচন্দ্র-রায়-গুণাকর-জ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *