বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাস ও বিকাশধারা
ছোটোগল্প বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যধারা, যা সংক্ষিপ্ত আকারে গভীর মানবতা, অনুভূতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করে। ইংরেজি “short story” ধারার প্রভাব নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের আবির্ভাব সাধারভাবে ১৯ শতকের মাঝামাঝি ঘটে। প্রথম দিকে এটি উপন্যাস ও দীর্ঘ কাহিনীর সঙ্গে অস্বচ্ছল—তবুও আছড়ে পড়ে পাঠকের মনোজগতে।
প্রাথমিক আগমন এবং নান্দিক ভিত্তি
বাংলা ছোটোগল্পের প্রথম আভাস পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “Yugalanguriya” (১৮৭৪) এবং “Radharani” (১৮৭৫) রচনায়। যদিও এ সময়ের লেখাগুলো এখনকার আক্ষরিক ছোটোগল্প নয়, তবে এগুলোতে “Novella” বা “উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত রূপ” বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান—যেমন পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের Madhumati এবং সংজীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের Rameswarer Adrsta, Damini ইত্যাদি।
আধুনিক ছোটোগল্পের প্রকৃত সূচনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভিখারিণী’ (১৮৭৭) বাংলা ভাষায় প্রথম সরকারি স্বীকৃত ছোটোগল্প হিসেবে গণ্য। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘ঘাটের কথা’র মতো গল্পে “শেষ হয়ে গেলেও রেশ থেকে যায়”—রবি ঠাকুরের দর্শন—প্রণীত, যা ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্যসমূহ সুস্পষ্ট করে দেন।
ঔপন্যাসিক থেকে স্বতন্ত্র ধারায় রূপান্তর
২১শ শতকের গবেষকেরা মনে করেন, ছোটোগল্প প্রথমে উপন্যাসের সঙ্গে আংশিক যুক্ত ছিল; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তার পণ্ডিত-সমালোচকরাও বাংলা ছোটোগল্পকে “স্বতন্ত্র শিল্পধারা” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষ করে “সংক্ষিপ্ত ভাঙা ভাঙা ক্ষুদ্র আঙিকে বৃহৎ অনুভূতি” ধারণ করে, যা ছোটোগল্পের প্রাণ।
প্রাথমিক বিকাশ ও সাহিত্য আন্দোলন: ১৮৭৭–১৯৩০
রবীন্দ্রনাথের অবদান
রবী ঠাকুর ছোটোগল্পে আবেগ, মানসিকতা ও সমাজের একাবিংশ শতাব্দীর চিত্র অঙ্কন করেন। ‘ভিখারিণী’, ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৮৯২)–র মধ্যে মানব সঙ্গীতা, মা-পুত্র সম্পর্ক, বৈচিত্র্য ও বৈপ্লবিক সংবেদন ফুটে ওঠে।
ত্রৈলোক্যনাথ ও অন্যান্য প্রারম্ভিক যোদ্ধারা
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারী দেবী ও নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রভৃতি কবি ও লেখক ছোটোগল্পের স্বতন্ত্র আঙ্গিকে অবদান রাখেন; যদিও উন্নয়ন প্রাথমিক স্তরে ছিল।
মিড-১৯০০–১৯৩০: সাহিত্যিক চেতনার পরিবর্তন
‘কল্লোল’ সাহিত্য আন্দোলন (১৯২৩–১৯৩৫) তরুণ লেখকদের সাহসী ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে—এতে লেখেন প্রমেংদ্র মিত্র, কাজী নজরুল ইসলাম, বনফুল ইত্যাদি। মধ্যযুগীয় ভাব থেকে মুক্ত হয়ে ছোটোগল্পে সমাজ–রাজনীতি–বিচিত্র দিক সংক্ষেপে উঠে আসে।
শৈল্য, সাহিত্যিক পরিমার্জনা ও আধুনিক বিকাশ
শৈল্যগত বিবর্তন ও ছোটোগল্পের নান্দনিকতা
বাংলা ছোটোগল্প তার যাত্রার শুরুতে ইউরোপীয় ছোটোগল্পের ছায়ায় হলেও পরবর্তীতে নিজস্ব ধারা গড়ে তোলে। গল্পের কাঠামো, ভাষা ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়।
ছোটোগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
– সংক্ষিপ্ততা ও একক প্রভাব
– বাস্তবতা ও মানবিক অনুভূতির মিশ্রণ
– চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপন
– ঘটনাকেন্দ্রিক না হয়ে অভিজ্ঞতা ও আবেগের উপর নির্ভর
– উপসংহারে মোচড় বা চমকপ্রদ পরিণতি
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী ছোটোগল্পের দিকবিন্যাস
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ছোটোগল্পে যে বৈচিত্র্য ও দৃঢ়তা আসে, তা নতুন দৃষ্টিকোণ দেয়।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মানবিক বাস্তবতা
‘মহেশ’, ‘হরিচরণ’ ইত্যাদি গ্রামীণ সমাজ, দরিদ্র কৃষক, পশুপ্রেম ও সহানুভূতির অনুপম দৃষ্টান্ত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: মনস্তত্ত্ব ও সংকট
‘প্রতিধ্বনি’, ‘শাশ্বত জীবন’ গল্পে মানুষের অভ্যন্তরীণ সংকট ও সমাজবদ্ধ জীবনের চিত্র আঁকা হয়েছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রকৃতি ও কাব্যিক মানবজীবন
‘ডহরু’, ‘তালন’ ইত্যাদি গল্পে প্রকৃতি, নিসর্গ ও নির্লিপ্ত মানবচরিত্রের সঙ্গে বাংলার মাটির ঘ্রাণ মিশে যায়।
১৯৪০–১৯৭১: রাজনৈতিক চেতনা ও বাস্তবতার প্রসার
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ লেখকের মাধ্যমে ছোটোগল্প হয়ে ওঠে সময়ের ভাষ্য।
আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক বাংলা ছোটোগল্প
সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক, মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ লেখক নাগরিক সভ্যতা, প্রযুক্তি ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে নতুন ধারায় গল্প লিখেছেন।
ছোটোগল্পের সাম্প্রতিক বৈশিষ্ট্য:
– মোবাইল ফরম্যাট উপযোগী রচনা
– নারীবাদ, পরিবেশ, প্রযুক্তি
– অনলাইন সাহিত্যের প্রভাব
বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্প শুধু একটি সাহিত্যধারা নয়—এটি সময়, সমাজ, মনন, চিন্তা ও ভাষার বহমান প্রতিচ্ছবি। এর বিবর্তন ও বিকাশ বুঝতে পারলে বাংলা সমাজ ও চিন্তার রূপান্তর বোঝা সহজ হয়।
https://www.munshiacademy.com/বাংলা-ছোটোগল্পের-ইতিহাস/