বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজন

Spread the love

বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজন

(প্রথম ধাপ: প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত)

ভূমিকা

বাংলা সাহিত্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা। এর শুরু হয়েছিল প্রায় এক সহস্রাব্দ পূর্বে, আর সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে একটি বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের বিবর্তন সময়ের সাথে সাথে যেমন সাহিত্যধারাকে পরিবর্তিত করেছে, তেমনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাবও এই সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই বিবর্তনের ভিত্তিতে সাহিত্য গবেষকেরা বাংলা সাহিত্যকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করেছেন। যুগ বিভাজনের এই ভিত্তি কখনো ভাষার রূপান্তর, কখনো ভাববিষয়, কখনোবা সাহিত্যরীতি ও ধর্মীয় প্রভাবের উপর নির্ভরশীল।

বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগের ভিত্তি

বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাজনে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে বাংলা সাহিত্যকে নিচের পাঁচটি যুগে বিভক্ত করা হয়:

  1. প্রাচীন যুগ (১১৫০–১৩৫০ খ্রিঃ)
  2. মধ্যযুগ (১৩৫০–১৮০০ খ্রিঃ)
  3. আধুনিক যুগ (১৮০০–১৯৪৭ খ্রিঃ)
  4. উত্তরআধুনিক বা পরবর্তী আধুনিক যুগ (১৯৪৭–বর্তমান)
  5. সাম্প্রতিক সাহিত্যধারা (২০০০–বর্তমান, কেউ কেউ আলাদাভাবে দেখেন)

প্রাচীন যুগ (১১৫০–১৩৫০ খ্রিঃ)

ভাষা ও বৈশিষ্ট্য

বাংলা সাহিত্যের সূচনাকাল বলা হয় এই সময়কে। এ যুগে রচিত সাহিত্যকে চর্যাপদ বা ‘চর্যা’ নামে চিহ্নিত করা হয়। চর্যাপদের রচয়িতারা ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়াগণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

প্রধান সাহিত্যিক ও রচনা

  • চর্যাপদ: বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য। প্রায় ৫০টি পদ পাওয়া গেছে।
  • প্রধান কবি: লুইপা, শবরপা, ভুসুকুপা, কুক্কুরীপা, দ্রুম্মিল, কানহাপা প্রমুখ।

বৈশিষ্ট্য

  • গূঢ় অর্থে পূর্ণ (সান্ধ্যভাষা)
  • ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন
  • শব্দ ও ভাষায় প্রাচীন রূপ (তৎসম, প্রাকৃত এবং দেশজের সংমিশ্রণ)

মধ্যযুগ (১৩৫০–১৮০০ খ্রিঃ)

মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ সময়কাল। এই যুগের সাহিত্য প্রধানত ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় রচিত হয়েছে এবং দুইটি প্রধান ধর্মীয় ধারায় বিভক্ত:
১. হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্য
২. মুসলিম ধর্মীয় সাহিত্য

(১) বৈষ্ণব পদাবলী বা ভক্তিকাব্য

এই ধারা মূলত চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত। বাংলা ভাষায় ভক্তিরসজাত কাব্য এই সময়ে ব্যাপকভাবে রচিত হয়।

  • প্রধান কবি: বিদ্যাপতি (মৈথিল কবি হলেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব অপরিসীম), চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, রামপ্রসাদ সেন
  • বিষয়বস্তু: রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, ভক্তিরস
  • ভাষা: সহজ, রসাত্মক, লোকজ উপাদানপূর্ণ

(২) মঙ্গলকাব্য

মঙ্গলকাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। এতে দেবদেবীদের মাহাত্ম্য ও পূজার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়।

  • বিখ্যাত মঙ্গলকাব্য:
    • চন্ডীমঙ্গল: কবি কৃত্তিবাস ও মুখুন্দরাম চক্রবর্তী
    • মনসামঙ্গল: কবি বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই
    • ধর্মমঙ্গল: রঘুনন্দন, রামাই পণ্ডিত প্রমুখ
  • বিষয়বস্তু: স্থানীয় দেবদেবীদের কাহিনি, সামাজিক প্রচার

(৩) অনুবাদ সাহিত্য

এ সময় ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ বাংলায় শুরু হয়। এটি হিন্দু সমাজে ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা ও নীতিকথা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

  • রামায়ণ: কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক অনুবাদ (কৃত্তিবাসী রামায়ণ)
  • মহাভারত: কাশীরাম দাস কর্তৃক অনুবাদ

(৪) মুসলিম ধর্মীয় সাহিত্য / ইসলামী প্রভাবিত কাব্য

তুর্কি-পাঠান শাসনের সময় বাংলায় মুসলিম কবিদের আবির্ভাব ঘটে, যারা ফারসি ও আরবি সাহিত্যরীতি অনুসরণ করে বাংলা কবিতা রচনা করেন।

প্রধান কবি ও কাব্য:

  • শেখ ফয়জুল্লাহ: ‘ইউসুফ-জুলেখা’
  • সায়েদ সুলতান: ‘নবীবংশ’
  • নূর কুতুব আলম, আব্দুল হাকিম, আলাওল, সৈয়দ শরীফুল্লাহ

আলাওল (১৬০৭–১৬৮০):

  • আরাকানে কর্মরত এই কবি ফারসি সাহিত্যের অনুবাদে দক্ষতা দেখান।
  • প্রধান রচনা:
    • পদ্মাবতী (মালিক মুহম্মদ জায়সীর পদ্মাবতের বাংলা রূপান্তর)
    • সইফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সত্যপীরের পদাবলী

বৈশিষ্ট্যসমূহ:

  • আখ্যানভিত্তিক কাব্য
  • ইসলামি ঐতিহ্য, নবীন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব
  • আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার
  • ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিকতা, প্রেম ও রূপকথার মিশ্রণ

মধ্যযুগের সামগ্রিক মূল্যায়ন

  • বাংলা সাহিত্যের মূলভিত্তি নির্মাণে মধ্যযুগ অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে।
  • ভাষা, ছন্দ, রস ও আঙ্গিকে বৈচিত্র্য দেখা যায়।
  • লোকজ উপাদান, পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয় উপাখ্যান এবং নৈতিকতার বিস্তার লক্ষণীয়।

অবশ্যই! নিচে “বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজন” প্রবন্ধের দ্বিতীয় ধাপ (শেষাংশ) উপস্থাপন করা হলো—
এ অংশে থাকছে আধুনিক যুগ, উত্তর-আধুনিক যুগ, সাম্প্রতিক সাহিত্যধারা, বিকল্প মত, এবং উপসংহার।

বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজন

(দ্বিতীয় ধাপ: আধুনিক যুগ থেকে সাম্প্রতিক সাহিত্যধারা পর্যন্ত)

আধুনিক যুগ (১৮০০–১৯৪৭ খ্রিঃ)

প্রেক্ষাপট

আধুনিক যুগের সূচনা ইংরেজ শাসনের প্রভাবে ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষা, ছাপাখানা, সংবাদপত্র, ধর্ম ও সমাজ সংস্কার এবং জাতীয় চেতনার বিকাশ এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এই যুগকে আবার তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়:

(১) প্রারম্ভিক আধুনিক যুগ (১৮০০–১৮৬০)

  • এ সময় বাংলা গদ্যের ভিত্তি নির্মিত হয়।
  • খ্রিস্টান মিশনারি ও সংস্কারক ব্যক্তিরা সাহিত্যে প্রভাব ফেলেন।

প্রধান সাহিত্যিকরা:

  • রাজা রামমোহন রায়: গদ্যের সূচনাকারী
  • ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: ভাষা ও শিক্ষায় অবদান
  • মাইকেল মধুসূদন দত্ত: মহাকাব্য ও কাব্যচর্চার নতুন রূপ (যেমন – মেঘনাদবধ কাব্য)
  • ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়: রম্যরচনায় পথিকৃৎ

(২) মধ্যবর্তী আধুনিক যুগ (১৮৬১–১৯০০)

  • কাব্য, নাটক ও উপন্যাসে নবজাগরণের প্রতিফলন ঘটে।
  • উপনিবেশবিরোধী চেতনা সাহিত্যকে দিকনির্দেশ করে।

প্রধান সাহিত্যিকরা:

  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: উপন্যাসের জনক (আনন্দমঠ, কপালকুণ্ডলা)
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সর্বস্তরের সাহিত্যকর্মে অনবদ্য অবদান (গীতাঞ্জলি, ঘরবাড়ি, শেষের কবিতা)
  • সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: বাস্তবধর্মী উপন্যাস

(৩) পরিণত আধুনিক যুগ (১৯০১–১৯৪৭)

  • জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ, বাস্তবতা এবং সমাজচেতনা এই সময়ের সাহিত্যকে প্রভাবিত করে।
  • কবিতা, নাটক ও ছোটগল্পে বিষয়বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয়।

প্রধান সাহিত্যিকরা:

  • কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহ ও মানবতার কণ্ঠস্বর (বিদ্রোহী, ভাঙার গান)
  • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: সমাজসচেতন উপন্যাস (দেবদাস, শ্রীকান্ত)
  • প্রমথ চৌধুরী: চলিত ভাষায় গদ্যরীতি প্রচলন
  • সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জসীমউদ্দীন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ

উত্তরআধুনিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ (১৯৪৭–২০০০)

প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, ভারত ও পাকিস্তান বিভাজন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলে।

(১) পূর্ববাংলা/পূর্ব পাকিস্তান পর্ব (১৯৪৭–১৯৭১)

  • রাজনৈতিক দমন, ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্র ও জাতীয় পরিচয়ের চেতনা সাহিত্যকে নতুন রূপ দেয়।
  • আসাদ চৌধুরী, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, জাহানারা ইমাম প্রমুখের সাহিত্য এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

বিষয়বস্তু:

  • ভাষা আন্দোলন, গ্রামীণ জীবন, ধর্ম ও জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব

(২) স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্য (১৯৭১–২০০০)

  • মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ক্ষত, আশা-নিরাশা, রাজনৈতিক ভাঙন, নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন—সবই উঠে আসে সাহিত্যে।

গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকরা:

  • আহমদ ছফা, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিম আল দীন, মোহাম্মদ রফিক, নাসরীন জাহান প্রমুখ।

সাহিত্যরীতি:

  • মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ও নাটক
  • নারীবাদী সাহিত্য
  • বিজ্ঞান কল্পকাহিনি
  • ছোটগল্পের নবপর্যায় (সৈয়দ শামসুল হক, জাফর ইকবাল)

সাম্প্রতিক সাহিত্য (২০০০–বর্তমান)

বৈশিষ্ট্য

  • প্রযুক্তি, সামাজিক মিডিয়া, গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব
  • ভিন্নতাবাদ, যৌনতা, আত্মচেতনা, পরাবাস্তবতা
  • ফ্যান্টাসি ও কিশোরসাহিত্য-এ নতুন দিগন্ত

প্রতিভাবান লেখক:

  • সালমা বানু, জুবায়ের মুক্তাদির, রিজওয়ানুল হক, নতুন প্রজন্মের সাহিত্যে অবদান রাখছেন
  • অনলাইন সাহিত্যব্লগ সাহিত্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছে

যুগ বিভাজন বিষয়ে বিতর্ক ও বিকল্প মত

বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজনে কিছু বিতর্ক রয়েছে:

  1. চর্যাপদকে কেউ কেউ সংস্কৃত সাহিত্য-সম্পর্কিত বলে মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের সূচনা হিসেবে নয়।
  2. আধুনিক যুগের সূচনাবিন্দু কোথা থেকে ধরা হবে—এই নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন ১৮০০, কেউ বলেন ১৮৫৭ বা বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ থেকেই প্রকৃত আধুনিকতা শুরু।
  3. উত্তরআধুনিক যুগকে কেউ কেউ আধুনিক যুগের সম্প্রসারণ বলে মনে করেন, কেউ আবার আলাদা ধারা হিসেবে দেখেন।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস মূলত এক ধারাবাহিক রূপান্তরের ইতিহাস। যুগে যুগে সাহিত্য তার ভাষা, রীতি, রস ও বিষয়বস্তুতে পরিবর্তিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। এই পরিবর্তনের পেছনে যেমন সময়, সমাজ ও রাজনীতির ভূমিকা আছে, তেমনি আছে ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা ও স্বপ্নের অনুরণন।

প্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের ডিজিটাল সাহিত্য পর্যন্ত—বাংলা সাহিত্য এক বিশাল পথ পাড়ি দিয়েছে। যুগ বিভাজন আমাদের সেই যাত্রার বিভিন্ন মোড় চিনে নিতে সাহায্য করে, আর তার বিশ্লেষণ আমাদের সাহিত্যচর্চাকে আরও বোধগম্য ও প্রাসঙ্গিক করে তোলে।

https://www.munshiacademy.com/বাংলা-সাহিত্যের-যুগ-বিভা/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *