মর্সিয়া সাহিত্য : উৎপত্তি ও প্রসার

Spread the love

মর্সিয়া সাহিত্য : উৎপত্তি ও প্রসার

বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা হলো মর্সিয়া সাহিত্য, যা মূলত শোকগাথা রচনার একটি ধর্মীয় ও সাহিত্যিক রূপ। মর্সিয়া শব্দটি এসেছে আরবি “মারসিয়া” (marsiyah) থেকে, যার অর্থ শোক বা বিলাপ। ইসলামি ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মূলত ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর অনুসারীদের কারবালার যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদত বরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সাহিত্যের জন্ম।

মর্সিয়া সাহিত্যের উৎপত্তি ও প্রসার
মর্সিয়া সাহিত্যের উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্যের আরবি ও ফারসি সাহিত্যে হলেও বাংলায় এর আবির্ভাব ঘটে মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের হাতে। বিশেষত শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে কারবালার শোক পালনের ঐতিহ্য থেকেই মর্সিয়া সাহিত্যের সূত্রপাত। তবে কেবল শিয়া মুসলিমই নয়, সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই সাহিত্য চর্চার রেওয়াজ দেখা যায়। বাংলায় মর্সিয়া প্রথম জনপ্রিয়তা পায় ১৭শ-১৮শ শতকে।

মর্সিয়া সাহিত্যের বিষয়বস্তু
মর্সিয়া সাহিত্যে প্রধানত কারবালার যুদ্ধ, হযরত হোসেন (রা.), হযরত আলী আকবর, হযরত আব্বাস, হযরত জয়নাব ও অন্যান্য শহীদদের বীরত্ব, ত্যাগ, দুঃখ এবং ইসলামের পক্ষে তাঁদের আত্মোৎসর্গের কাহিনি বর্ণিত হয়। এ কাব্যে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা ও ধর্ম-অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্ব উঠে আসে গভীর আবেগ ও নাটকীয়তায়।

রচনাশৈলী ও গঠন
মর্সিয়া সাহিত্য সাধারণত ছন্দোবদ্ধ, পদ্যরূপে রচিত হয়। এতে শোক, বিলাপ, নৈরাশ্য, আত্মত্যাগ ও আশার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। বাংলা মর্সিয়া কবিতাগুলোতে ফারসি-আরবি শব্দের প্রভাব ব্যাপক। এটি অনেকসময় কাহিনিনির্ভর উপাখ্যানের আকারে উপস্থাপিত হয়, যেখানে বর্ণনা, সংলাপ এবং আবেগময় চিত্রায়নের সমন্বয় ঘটে।

বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য মর্সিয়া কবি ও রচনা
বাংলা সাহিত্যে মর্সিয়া সাহিত্যের কিছু উল্লেখযোগ্য কবি হলেন:

তাঁদের রচিত মর্সিয়া কাব্যগ্রন্থগুলোতে কারবালার কাহিনি, হযরত হোসেনের শাহাদত, ইসলাম রক্ষার বার্তা ও ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে।

মাহে মুহাররম ও মর্সিয়া পাঠ
প্রতিবছর ইসলামী বর্ষপঞ্জির ১০ মহররম, যা আশুরা নামে পরিচিত, এই দিনকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজে মর্সিয়া পাঠ, জারিগান এবং শোকানুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এসব অনুষ্ঠানে মর্সিয়া কাব্য আবৃত্তি করা হয়, গীত হয় বা পাঠ করা হয়, যা ধর্মীয় অনুভূতির বাইরে এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সাহিত্যিক ও সামাজিক গুরুত্ব
মর্সিয়া সাহিত্য কেবল ধর্মীয় আবেগ প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের এক দুঃখবোধময় ধারারও প্রতীক। সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কাব্যিক ব্যঞ্জনা, অলঙ্কার ও আবেগ প্রকাশে সমৃদ্ধ। সমাজের নৈতিক চেতনা, আত্মত্যাগ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা হিসেবেও এই সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মর্সিয়া সাহিত্য বাংলা সাহিত্যকে একটি গভীরতর ভাবনার স্তরে নিয়ে গেছে। এটি ধর্মীয় ইতিহাস ও আবেগকে শিল্পরূপে উপস্থাপন করার এক অনন্য উদাহরণ। বাংলা ভাষায় মর্সিয়া সাহিত্য যতটা ধর্মপ্রাণ মানুষের অন্তরে দাগ কেটেছে, ঠিক ততটাই সাহিত্যিক বৈচিত্র্য ও সম্পদের সম্ভারও তৈরি করেছে। আজও এটি ধর্মীয় ও সাহিত্যিক উভয় দিক থেকেই মূল্যবান একটি ধারা হিসেবে বিবেচিত।

https://www.munshiacademy.com/মর্সিয়া-সাহিত্য-উৎপত্ত/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *