স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাটক

Spread the love

 

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাটক: সময়, সমাজ ও প্রতিরোধের প্রতিধ্বনি

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে নাটক এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যার মাধ্যমে জাতি তার আত্মপরিচয়, প্রতিরোধ, আশা ও বাস্তবতার কথা বলে এসেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে নাটক হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দলিল—যেখানে জাতি নির্মাণ, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য এবং মানবাধিকার প্রশ্নে নাট্যকারেরা তাঁদের শৈল্পিক প্রতিবাদ ও বয়ান উপস্থাপন করেন।

স্বাধীনতার পরে নাট্যচর্চা বহুমাত্রিক আকার ধারণ করে—একদিকে মঞ্চনাটক, অন্যদিকে টেলিভিশন, রেডিও, এবং পরবর্তীতে বিকল্প থিয়েটার আন্দোলন নাটককে জনগণের নিকট নিয়ে যায়। এই প্রবন্ধে স্বাধীনতা-পরবর্তী নাটকের ধারা, বিষয়বস্তু, ভাষা, কাঠামো ও নাট্যকারদের অবদান বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট ও নাট্যজগতের রূপান্তর

১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সৃষ্ট হয় নতুন রাষ্ট্র। এই নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণ, রাজনৈতিক আদর্শের ভাঙন, সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন, ন্যায়বিচারহীনতা—সবই নাটকের বিষয় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম এক দশকে নাট্যকারেরা তাঁদের কলমের শক্তি দিয়ে জাতির যন্ত্রণাকে রূপ দেন নাট্য-রুপকে।

🎭 প্রতীক:
নাট্য মঞ্চ = জাতির আয়না,
চরিত্র = জনগণের আত্মপ্রতিবিম্ব,
সংলাপ = প্রতিরোধের ভাষা

প্রথম দশক (১৯৭১–১৯৮০): মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত ও জাতি-নির্মাণ

🔹 সেলিম আল দীন

বাংলা নাট্যধারায় নতুন শৈলী এনেছিলেন। তাঁর ‘সংশয়ী বৃত্তান্ত’, ‘হাত হদাই’, ‘যৈবতী কন্যার মন’ ইত্যাদিতে ইতিহাস, লোকঐতিহ্য এবং শারীর-ভাষাভিত্তিক নাট্যচর্চার প্রবর্তন ঘটে। তিনি বাংলা নাটকে নাট্যশাস্ত্রীয় মৌলিকত্বের জনক বলে বিবেচিত।

🔹 মামুনুর রশীদ

আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর লেখা ও নির্দেশনায় ‘রক্ত করবী’ (রবীন্দ্রনাথ ভিত্তিক রূপায়ণ), ‘রাঢ়াঙ’ ও ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে গ্রামীণ শোষিত জনগণের প্রতিরোধ ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের যন্ত্রণাকে সামনে আনা হয়।

🔹 আফসার আহমেদ

তাঁর নাটকগুলোতে স্বাধীনতার আদর্শ ও গণমানুষের বঞ্চনা বারবার উঠে এসেছে, যেমন ‘বৈশাখী ঝড়’ বা ‘সময়ের গল্প’।

আশির দশক (১৯৮১–১৯৯০): সামরিক শাসন, বঞ্চনা ও আত্মসন্ধান

এই সময় নাটকে আসে রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও প্রতীকময়তা। সামরিক শাসনের নিষ্ঠুরতা, বাকস্বাধীনতার সংকোচন নাট্যকারদের ভাবনার কেন্দ্রে আসে।

🔹 সেলিম আল দীন – ‘চাকা

এটি এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নাটক, যেখানে এক মৃতদেহ বহনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও মানবসভ্যতার দায়চিন্তা তুলে ধরা হয়। এটি নাটকের জগতে দার্শনিক নাট্যপ্রতিমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

🔹 নাসিরউদ্দিন ইউসুফ

ধ্রুপদী নাট্যশৈলী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (লিখেছেন সেলিম আল দীন) – মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক অমর রচনা, যেখানে মাটি ও মানুষের ভাষা একত্রে কাঁপিয়ে তোলে দর্শককে।

🎭 প্রতীক:
চাকা = সময়ের অনিবার্যতা,
মৃতদেহ = অতীতের দায়,
মঞ্চ = বিদ্রোহের ক্ষেত্র

নব্বইয়ের দশক: গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ও নাগরিক নাটক

এই সময়কালে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। নাটকে উঠে আসে নাগরিক উদ্বেগ, মধ্যবিত্ত জীবনের সংকট, নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা, এবং আধুনিক সমাজের দ্বান্দ্বিকতা।

🔹 সুবর্ণা মুস্তাফা ও আবুল হায়াত

টেলিভিশন নাটকে এই সময় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বিটিভির ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’, ‘তৃষ্ণা’—এগুলো সামাজিক বাস্তবতা ও নাটকীয় নির্মাণে সফল।

🔹 হুমায়ূন আহমেদ

এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্যকার। ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’ নাটকে হালকা হাস্যরস, মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম ও মানবিক টানাপোড়েন তুলে ধরেছেন।

🎭 প্রতীক:
বাক্যে ব্যঙ্গ = শাসকের প্রতি রম্য সমালোচনা,
চরিত্রের নির্বাকতা = সামাজিক ক্লান্তি

একবিংশ শতাব্দী: বিকল্প থিয়েটার, লুপ্ত ইতিহাস ও নাগরিক সংকট

এই সময় নাটক হয়ে উঠেছে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর। বিকল্প থিয়েটার, পথনাটক, প্রামাণ্য নাটক এবং ইতিহাসভিত্তিক নাটক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

🔹 নাসিরউদ্দিন ইউসুফ – ‘লালসালু’ (নাট্যরূপ)

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের নাট্যরূপায়ণ, যা ধর্মীয় প্রতারণা ও সমাজের অন্ধবিশ্বাসকে মঞ্চে আনে।

🔹 আরিন্দম নাট্যদল, শব্দনাট্য, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, বহুবচন

এই দলগুলো ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়, সংখ্যালঘুদের দুঃখগাঁথা এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করছে। ‘গহীন দেশের নাটক’, ‘জলজ জান্নাত’ প্রভৃতি নাটক এই ধারার অন্তর্ভুক্ত।

🔹 রুবী রহমান, শামীম আজাদ, সৈয়দ জামিল আহমেদ

নাটকে নারীর কণ্ঠ, পরিসর ও ভাবনার বিস্তার ঘটিয়েছেন।

🎭 প্রতীক:
আলো-আঁধারির খেলা = স্মৃতি ও বর্তমানের দ্বন্দ্ব,
দেহভাষা = অনুচ্চারিত প্রতিবাদ

প্রতিনিধিত্বশীল নাট্যকার ও নাটক তালিকা

নাট্যকার উল্লেখযোগ্য নাটক বিষয়বস্তু
সেলিম আল দীন চাকা, যৈবতী কন্যার মন, হাত হদাই ইতিহাস, ভাষা, দর্শন
মামুনুর রশীদ ময়ূর সিংহাসন, রাঢ়াঙ প্রান্তিকতা, প্রতিবাদ
হুমায়ূন আহমেদ কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি নগরজীবন, হাস্যরস
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ
আফসার আহমেদ বৈশাখী ঝড় গ্রামীণ বাস্তবতা
সৈয়দ জামিল আহমেদ পোস্টার, মঞ্চরেখা নির্দেশনা-নাট্যকলা
আরিন্দম থিয়েটার জলজ জান্নাত পরিবেশ ও প্রান্তিকতা

নাট্য মাধ্যমের বিবর্তন

মাধ্যম বৈশিষ্ট্য
মঞ্চনাটক জনমুখী, রাজনৈতিক সচেতনতা প্রবল
পথনাটক সরাসরি প্রতিবাদ, গণতান্ত্রিক স্বর
টেলিভিশন নাটক নাগরিক জীবন, মধ্যবিত্তের সংকট
বিকল্প থিয়েটার নিরীক্ষাধর্মী, স্থানিক বৈচিত্র

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠেছে। এটি শুধু বিনোদনের ক্ষেত্র নয়—বরং রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির মাঝে সংলাপ তৈরি করে, সময়কে ধারণ করে রাখে। নাট্যকারেরা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে ইতিহাসের গোপন অধ্যায় উন্মোচন করেছেন, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর গড়ে তুলেছেন এবং জাতিসত্তার আয়না তুলে ধরেছেন।

নাটক হয়ে উঠেছে মঞ্চিত সময়, যেখানে জীবনের প্রতিটি পঁচিশ মিনিট একেকটি ইতিহাস।

https://www.munshiacademy.com/স্বাধীনতা-উত্তর-বাংলাদে-3/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *