কবি আবদুল হাকিম : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যেসব কবি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় নির্ভীক কণ্ঠে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে কবি আবদুল হাকিম অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যস্রষ্টা, ভাষাপ্রেমী ও সংস্কৃতিমনা বাঙালি। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁকে করেছে চিরস্মরণীয়।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

কবি আবদুল হাকিম আনুমানিক ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সুধারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে কিছু সূত্র মতে, তাঁর জন্ম নোয়াখালী জেলার সুধারামের বাবপুর গ্রামে। তাঁর জন্মকালটি ছিল পর্তুগিজ শাসনাধীন চট্টগ্রামের সময়। আবদুল হাকিম শৈশবেই বিদ্যাশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং অল্প বয়সেই আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ধর্মীয় জ্ঞান, ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চায় ছিলেন পারদর্শী।

সাহিত্যজীবন ও কীর্তি

বাংলা ভাষায় সাহিত্যরচনা ছিল তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। সে সময়ের অভিজাত ও শিক্ষিত সমাজে ফার্সি ভাষার প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রবল; অনেকেই বাংলা ভাষাকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন। আবদুল হাকিম এই প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠে লিখেছিলেন—

“যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”

এই পংক্তির মধ্য দিয়ে কবি শুধু নিজের ভাষাপ্রেমই প্রকাশ করেননি, বরং বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন।

তিনি বাংলা ভাষায় ধর্মীয়, আখ্যানমূলক ও শিক্ষামূলক বহু কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর রচনায় ফার্সি কাব্যের প্রভাব থাকলেও তিনি নিজস্ব ভাবধারা ও বাংলা ছন্দে তা রূপান্তরিত করেছেন।

প্রধান গ্রন্থসমূহ

কবি আবদুল হাকিমের আটটি কাব্যের কথা জানা যায়। এর মধ্যে ‘নূরনামা’ তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। এতে তিনি নবী মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী কাব্যরূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো—

  1. ইউসুফ-জুলেখা – প্রেম ও ধর্মীয় শিক্ষার আখ্যান।
  2. লালমতি – উপাখ্যানমূলক কাব্য।
  3. সয়ফুলমুলুক – কাব্যনাট্যধর্মী প্রেমকাহিনি।
  4. নসিহৎনামা – নৈতিকতা ও ধর্মীয় উপদেশনির্ভর গ্রন্থ।
  5. শাহাবুদ্দিননামা – ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত।
  6. কারবালা ও শহরনামা – কারবালার শোকাবহ কাহিনি।
  7. চারি মোকাম ভেদদূররে মজলিস – আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষার উপাখ্যান।

সাহিত্যভাবনা ও ভাষাচেতনা

আবদুল হাকিমের সাহিত্যচিন্তায় দুটি মূল দিক লক্ষ্য করা যায়—ধর্মীয় ও জাতীয় চেতনা। তিনি ইসলামি কাহিনিকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করে সাধারণ মানুষের কাছে তা সহজবোধ্য করেছেন। তাঁর রচনায় ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে মানবপ্রেম, নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের মিশেল রয়েছে।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর গর্ববোধ ও শ্রদ্ধা। তিনি মনে করতেন, মাতৃভাষার অবমূল্যায়ন মানে জাতির আত্মপরিচয়ের অবমূল্যায়ন। এই চেতনার কারণে তাঁকে “ভাষাচেতনার অগ্রদূত” বলা যায়।

মৃত্যু

কবি আবদুল হাকিম ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ৬৯ বা ৭০ বছর

উপসংহার

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে আবদুল হাকিম কেবল একজন কবিই নন, তিনি এক প্রতীক—ভাষাপ্রীতি ও বাঙালি আত্মচেতনার প্রতীক। তাঁর রচনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি জাতির আত্মা, সংস্কৃতি ও সত্তার প্রতিফলন।