চর্যাপদে প্রবাদ বাক্যের ব্যবহার

Spread the love

চর্যাপদে প্রবাদ বাক্যের গবেষণামূলক প্রবন্ধ

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গীতিময় প্রার্থনা ও দর্শনীয় গ্রন্থ, যা ৮ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে রচিত বলে ধারণা করা হয়। চর্যাপদের ভাষা, সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা ও দৈনন্দিন জীবনচিত্রের অমূল্য চিত্রায়ন এ গ্রন্থে বিদ্যমান। এর মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে প্রবাদ বাক্য—যা সমাজের নানান পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত, সহজ অথচ গভীর বাণী হিসেবে চিরন্তন মূল্য বহন করে।

এই প্রবন্ধে চর্যাপদে অন্তর্ভুক্ত ৬টি নির্বাচিত প্রবাদ বাক্যের বিশ্লেষণ ও তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হবে।

চর্যাপদে নির্বাচিত প্রবাদ বাক্যসমূহ

প্রবাদ পদে অবস্থান কবির নাম অর্থ
১. আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী ৬ নং পদ ভুসুকুপা হরিণের মাংসই তার জন্য শত্রু
২. হাতের কাঙ্কন মা লোউ দাপন ৩২ নং পদ সরহপা হাতের কাঁকন দেখার জন্য দর্পণের প্রয়োজন হয় না
৩. হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ৩৩ নং পদ ঢেগুণ পা হাড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন প্রেমিকেরা এসে ভীড় করে
৪. দুহিল দুধু কী বেন্টে সামায় ৩৩ নং পদ ঢেগুণ পা দোহন করা দুধ কি বাটে প্রবেশ করানো যায়?
৫. বর সুন গোহালী কিমু দুঠ্য বলন্দেঁ ৩৯ নং পদ সরহপা দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো
৬. আন চাহন্তে আন বিনধা ৪৪ নং পদ কঙ্কন পা অন্য চাহিতে, অন্য বিনষ্ট

১. প্রবাদ বাক্যের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যায়ন

প্রবাদ বাক্যগুলো সাধারণত সরল অথচ গভীর অর্থ বহন করে। চর্যাপদে এই প্রবাদ বাক্যগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও চিন্তাধারার প্রভাব প্রতিফলিত করে। বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে এগুলো ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

১.১ “আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী”

ভুসুকুপার রচিত এ প্রবাদ বাক্যটির অর্থ: নিজের শরীরের অংশ বা প্রিয় বস্তু যদি শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেটি পরিহার করাই শ্রেয়। সামাজিক জীবনে এটি আত্মবিমুখতা ও স্বার্থপরতার বিপরীত শিক্ষার প্রতীক। আত্মজ্ঞান ও নিজস্ব দুর্বলতা চেনার নির্দেশনা রয়েছে এখানে।

১.২ “হাতের কাঙ্কন মা লোউ দাপন”

সরহপার এ প্রবাদ বাক্য মানুষের আত্মবিশ্বাস ও আত্মপরিচয়ের মুল্য তুলে ধরে। দর্পণ বা বাহ্যিক প্রতিফলন ছাড়াই নিজের ক্ষমতা ও সৌন্দর্য বোঝার গুরুত্ব প্রকাশ করে। আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পরামর্শ এই বাক্যে নিহিত।

২. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট

চর্যাপদ রচনার সময় বাংলার সমাজ কাঠামো ছিল মূলত কৃষিপ্রধান, ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম-কানুনে আবদ্ধ। এসব প্রবাদ বাক্য সমাজের আচরণগত নিয়ম, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের রীতি নির্দেশ করে।

২.১ “হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী”

ঢেগুণ পা কবির এই প্রবাদ বাক্যটি অর্থনৈতিক সংকট ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভ্রান্তি বোঝায়। যিনি প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারেন না, তিনি ভ্রান্তিপূর্ণ আচরণও করে থাকেন। সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এই বাক্যটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে।

২.২ “দুহিল দুধু কী বেন্টে সামায়”

এখানে দুধ দোহনের কাজের সাথে বাটে দুধ ঢালার অমিল তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, একটি কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বা উপায় প্রয়োজন। এটি কর্মদক্ষতা ও উপযুক্ততা নির্দেশ করে।

৩. নৈতিক শিক্ষা ও জীবনমুল্যবোধ

প্রবাদ বাক্যগুলোতে মানব জীবনের বাস্তবতা, সম্পর্কের জটিলতা ও নৈতিকতার দিকনির্দেশনা বিদ্যমান।

৩.১ “বর সুন গোহালী কিমু দুঠ্য বলন্দেঁ”

সরহপার প্রবাদটি বলে, খারাপ বস্তু বা অবস্থা থেকে দূরে থাকা শ্রেয়। দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল বেশি ভালো, অর্থাৎ খারাপ পরিবেশ বা লোকের সঙ্গে থাকা থেকে শূন্যতা বা একাকিত্বই উত্তম। এটি নৈতিকতার উপর গুরুত্বারোপ করে।

৩.২ “আন চাহন্তে আন বিনধা”

কঙ্কন পা কবির এ বাক্যটি মানুষের দ্বৈতচরিত্র ও ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা প্রকাশ করে। অন্যের প্রতি চাহিদা বা প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অমিলকে নির্দেশ করে। এটি সতর্ক করে দেয় ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সমাজে অবিশ্বাস থেকে বিরত থাকার জন্য।

৪. প্রবাদ বাক্যের ভাষা ও কবিদের বৈশিষ্ট্য

চর্যাপদের কবিরা প্রবাদ বাক্যের মাধ্যমে তাদের দর্শন, জীবনদর্শন ও সামাজিক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষা ছিল সরল, বোধগম্য এবং অভিজ্ঞতামূলক।

কবি বৈশিষ্ট্য
ভুসুকুপা গভীর আধ্যাত্মিকতা ও আত্মসচেতনতা প্রকাশকারী
সরহপা সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধি
ঢেগুণ পা বাস্তব জীবনের দুঃখ-কষ্টের প্রতিফলন
কঙ্কন পা মনস্তাত্ত্বিক ও সম্পর্কভিত্তিক দর্শন

৫. প্রবাদ বাক্যের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

আজকের দিনে চর্যাপদের প্রবাদ বাক্যগুলোও প্রাসঙ্গিক। আধুনিক সমাজে যেখানে আত্মপরিচয়, নৈতিকতা, সম্পর্ক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্ন উঠছে, সেখানে এই প্রবাদ বাক্যগুলো মানুষের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, “হাতের কাঙ্কন মা লোউ দাপন” বাক্যটি আজকের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানের প্রতীক। আবার “বর সুন গোহালী কিমু দুঠ্য বলন্দেঁ” আজকের বিষাক্ত পরিবেশ ও সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকার পরামর্শ দেয়।

৬. উপসংহার

চর্যাপদের প্রবাদ বাক্যগুলো শুধুমাত্র প্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন নয়, বরং এগুলোতে নিহিত রয়েছে মানব জীবনের সার্বজনীন নীতি ও মূল্যবোধ। এই প্রবাদ বাক্যগুলো সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে সুষম ও পরিপূর্ণ করে তোলে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে চর্যাপদের এই প্রবাদ বাক্যসমূহ আজও আমাদের জীবনপথের দিশারি।

৭. উল্লেখযোগ্য চিহ্ন ও সাংকেতিক ব্যাখ্যা

চিহ্ন অর্থ
প্রবাদ বাক্যের সংখ্যা বা বিন্যাস
কবির নামের নির্দেশক
বাণীর উদ্দেশ্য বা ব্যাখ্যা নির্দেশক
প্রবাদ বাক্যের সাংকেতিক অর্থ বা উপমা
বিশেষ গুরুত্ব বা নজরদারি নির্দেশক

গ্রন্থসূত্রঃ

  • চর্যাপদ, বাংলা একাডেমি প্রকাশন, ২০০৫
  • বৌদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ড. এম এ আজিজ, ২০১০
  • প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, অধ্যাপক শামীম আহমেদ, ২০১৫
  • বাঙালি লোকজ ও প্রবাদ, সৈয়দ মুজাহিদ, ২০১৮

 

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদে-প্রবাদ-বাক্যের/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *