চর্যাপদের সমাজচিত্র: গবেষণামূলক বিশ্লেষণ

Spread the love
চর্যপদের ধর্ম
চর্যপদের ধর্ম

✍️ চর্যাপদের সমাজচিত্র: একটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণ

সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। অ্যারিস্টটল-এর মতে, “Art is imitation of life”—অর্থাৎ শিল্প জীবনেরই অনুকরণ। কবি সাহিত্যিকরা যে সমাজে বসবাস করেন, সেই সমাজের ধর্ম, অর্থনীতি, জীবনধারা, রীতি-রেওয়াজ, আচার-আচরণ—সবই কোনো না কোনোভাবে তাঁদের রচনায় প্রকাশ পায়, কখনো সচেতনভাবে, কখনোবা অনিচ্ছাকৃতভাবে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ—যা প্রধানত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনা ও ধর্মতত্ত্বকেন্দ্রিক—তাও এর ব্যতিক্রম নয়। সিদ্ধাচার্য কবিগণ ধর্মতত্ত্ব, গুরুবাদ ও মুক্তির পথ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তৎকালীন সমাজ ও জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এইসব চিত্র তাঁদের সাধনগীতির অন্তরালেই ধরা দিয়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিক ও সমাজ-গবেষকদের জন্য তা হয়ে উঠেছে অমূল্য দলিল।

🔷 নদীমাতৃক বাংলার ভূপ্রকৃতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা

চর্যাপদের বিভিন্ন পদে নদী, খেয়া, নৌকা, দাঁড়, বঁইচি ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ প্রমাণ করে যে চর্যাগান রচনার সময়কার বাংলা ছিল একটি নদীমাতৃক অঞ্চল। সরহপাদ বলেন:

“নৌবাহী নৌকা টান অ গুণে”

এই পঙক্তি নৌচালনার বাস্তবতা, জলপথের যাত্রা এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপন তুলে ধরে। বাংলার বিস্তীর্ণ নদীনির্ভর জীবনের সঙ্গে কাব্যিক চিত্রের এমন সংমিশ্রণ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীনকালের এক অনন্য উদাহরণ।

🔷 শ্রেণিবিন্যাস ও জীবিকার বৈচিত্র্য

চর্যাপদে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কথা—মাঝি-মাল্লা, শবর, তাঁতি, মাহুত, শুঁড়ি, নট, কাপালিক প্রভৃতি। এরা সবাই ছিল সমাজের নিম্নশ্রেণীভুক্ত। সেই সঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছে জীবিকার ভিন্নতা—নৌকা চালনা, পশু শিকার, দুগ্ধ দোহন, চাঙারি বোনা, তাঁত বোনা, গৃহস্থালি কাজ ইত্যাদি। এইসব পেশা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।

এছাড়াও, চর্যাকারদের অনেকেই নিজেই ছিলেন এসব শ্রেণি বা পেশার সঙ্গে যুক্ত। যেমন: ডোম্বী, মৎস্যজীবী, চর্মজীবী, ইত্যাদি জাতির অস্তিত্বের চিত্র এখানে মুদ্রিত।

🔷 দরিদ্র মানুষের দুঃসহ জীবনচিত্র

চর্যাপদের একাধিক পদের ভাষায় উঠে এসেছে সমাজের নিম্নশ্রেণীর দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থার বর্ণনা। সরহপাদের একটি পদে বলা হয়েছে:

“হাঁড়িতে ভাত নাহি, নিতি আবেশী”
(অর্থাৎ হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ মাতালতা প্রতিদিনের)

এটি শুধু দরিদ্রতারই নয়, নেশাগ্রস্ত নিম্নবর্গের মাদকাসক্ত জীবনেরও প্রতিচ্ছবি। অভাব, অনটন এবং সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতা চর্যাপদের মধ্যে এক অনুপম বাস্তবতাবোধ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

🔷 অরাজক সমাজ ও দস্যু আতঙ্ক

চর্যাপদে উল্লিখিত হয়েছে চোর-ডাকাতের উৎপাত, যা প্রমাণ করে তৎকালীন সমাজ ছিল কিছুটা অরাজক, নিরাপত্তাহীন

“কানেট চৌরে নিল” (চোর কানের অলংকার নিয়ে পালালো)
“সোনা রুয়া মোর কিম্পি ণ থাকিউ” (আমার সোনা-রূপা কিছুই রইল না)

এই পঙক্তিগুলো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও দস্যুবৃত্তির চিহ্ন বহন করে।

🔷 বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো

চোর-ডাকাতের উল্লেখ থাকলেও সমাজে তখন বিচারব্যবস্থা চালু ছিল। চর্যাপদের বিভিন্ন পদে ‘দুষাধী’ (দারোগা), ‘উআরি’ (থানা বা আদালত) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই সব শব্দ ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে তৎকালীন সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ এবং বিচারব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল, যদিও তা হয়তো দুর্বল বা সীমিত ছিল।

🔷 খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন

চর্যাপদে কিছু কিছু পদে খাদ্যাভ্যাসের উল্লেখ আছে, যেমন:

  • ভাত, দুধ, মাছ, ফলমূল, হরিণের মাংস—এগুলি ছিল সাধারণ খাদ্যপণ্য।
  • নেশার উপাদান হিসেবে মদ্যপান ও মাতাল আচরণ চিত্রিত হয়েছে।

এইসব তথ্য তৎকালীন মানুষের খাদ্য সংস্কৃতি, উৎসব ও জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়। বিশেষ করে নিম্নশ্রেণির মানুষদের জীবনের অনিয়ন্ত্রিত, কখনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সাহিত্যের ভাষায় বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

🔷 সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবের চিত্র

চর্যাপদের কিছু পদে বিবাহ, নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সামাজিক উৎসবের চিত্র আঁকে।

উদাহরণ:
“ডোম্বী বিবাহিআ আহারিউ জাম”—এখানে ডোম্বী জাতির বিবাহ অনুষ্ঠানে ‘আহার’ তথা ভোজের কথা বলা হয়েছে।
“নাচন্তী গাইল বাজন্তী দেবী”—এই পংক্তিতে নৃত্য, সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের মিলনে উৎসবের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে।

এছাড়াও, বাঁশি, বীণা, মাদল, ডমরু ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ তৎকালীন লোকসংস্কৃতির অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

🔷 যৌতুকপ্রথা ও বিবাহ প্রথা

চর্যাপদে বর্ণিত হয়েছে তৎকালীন বিবাহ প্রথা ও যৌতুক প্রথার অস্তিত্ব।
“জাউতুকে কি আনতু ধাম”—এই পংক্তি যৌতুককে একটি সামাজিক রীতিরূপে প্রতিষ্ঠা করে।

বিবাহ উৎসবে ‘আহার’, ‘বাজনা’, ‘পূজাচর্চা’ এবং ‘গৃহস্থালি উপহার’ প্রদানের যে চিত্র পাই, তা সামাজিক ব্যবস্থার গভীরে প্রচলিত রীতিনীতির পরিচয় বহন করে।

🔷 গৃহস্থ সংসার ও নারীজীবন

চর্যাপদে বিভিন্ন স্থানে গৃহস্থ সংসার, নারী, পরিবারের সদস্য, হাঁড়ি-পাতিল, আঁতুরঘর, টাঙ্গি-কুঠার ইত্যাদি গৃহস্থালি উপকরণ-এর উল্লেখ আছে।

শশুর-শাশুড়ি, ননদ, গৃহবধূ, স্ত্রীলোকের আচার আচরণ—এই সবের প্রেক্ষাপটে সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, নারীজীবন ও গৃহজীবনের নিখুঁত চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।

🔷 জাতপাত, বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতা

চর্যাপদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমাজচিত্র হলো তৎকালীন জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার ভয়াবহতা। একাধিক পদে এই বিষয়ে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

“টালত ঘর মোর নাহি পড়বেশী”—এই পংক্তি অস্পৃশ্য জাতির নিঃসঙ্গতা ও সামাজিক বর্জনের যন্ত্রণাকে জীবন্ত করে তোলে। এখানে ‘পড়বেশী’ না থাকার অর্থ—একঘরে, সমাজচ্যুত হওয়া।

এছাড়াও, বিভিন্ন পদে ডোম, শবর, চর্মকার, ডাকাত প্রভৃতি অনগ্রসর শ্রেণির উল্লেখ প্রমাণ করে সমাজে শ্রেণিচ্যুতি ও বৈষম্যের প্রচলন ছিল।

✅ উপসংহার

চর্যাপদ মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন সংগীত হলেও তা নিছক ধর্মীয় কাব্যগ্রন্থ নয়—বরং তৎকালীন গৌড়-বঙ্গের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক জীবনের দলিল। সমাজের অন্তজ শ্রেণির জীবনযাপন, দারিদ্র, অসাম্য, রীতিনীতির অবক্ষয়, ধর্মীয় আচার, বিবাহ-প্রথা, গৃহস্থালি জীবন, বিচার ব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, নেশা, উৎসব—এই সমস্ত কিছুই চর্যাপদে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে এটি সমাজসংস্কৃতি গবেষণার এক অনন্য উৎস

যেমন ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেছিলেন:
“চর্যাপদ বৌদ্ধ সাধনার কাব্যমাত্র নয়, সে সমকালীন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি-জীবনের একটি দালানকাঠামোর ভিত।”

📚 রেফারেন্স

  1. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, Buddhist Mystic Songs (Charyapada)
  2. ড. নীহাররঞ্জন রায়, Bangalir Itihas: Adi Parva
  3. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত
  4. ভূদেব চৌধুরী, চর্যাপদের সমাজচিত্র
  5. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, The Origin and Development of the Bengali Language

📎 @munshi.academy | 🌐 www.munshiacademy.com | 🎙️ গবেষণা ও বর্ণনা: মুনশি আলিম

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-সমাজচিত্র-গবে/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *