চর্যাপদ: বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

Spread the love

চর্যাপদ: বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

chorjapod cover
chorjapod cover

সাহিত্য যতই কালোত্তীর্ণ হোক না কেন, তা তার জন্মকাল ও পরিবেশের প্রতিচ্ছবি বহন করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমনই এক অমূল্য নিদর্শন হলো চর্যাপদ—প্রাচীনতম বাংলা কবিতার সংকলন। এর রচনাকাল খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। চর্যাপদ শুধু সাহিত্য নয়, বরং একাধারে ধর্ম, দর্শন, সমাজচিত্র ও ইতিহাসের আয়না। এটি পাল ও সেন যুগের রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার এক জীবন্ত প্রতিবিম্ব।

চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয় ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর হাত ধরে। তারই অনুবাদ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাঙালি প্রথম জানল, সাহিত্যচর্চার সূচনা বাংলাভাষায় হয়েছিল অনেক পূর্বেই—মনসামঙ্গল কাব্যেরও প্রায় আড়াই শতাব্দী আগে।

🔸 ধর্ম সমন্বয়ের দলিল

চর্যাপদ একদিকে যেমন বৌদ্ধ সহজযান দর্শনের উপর ভিত্তি করে গঠিত, অন্যদিকে তাতে পাওয়া যায় হিন্দু তান্ত্রিক ও জৈন ভাবনার ছায়া। এই সমন্বয় চর্যাপদকে এক অনন্য ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ড. নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই বলেন, “চর্যাপদ হলো বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনার সঙ্গে বাংলার লোকাচার ও দেহবাদী তত্ত্বের ঐতিহাসিক মিলনের নিদর্শন।”

এই মিলন বৌদ্ধধর্মের পতনের সূচনালগ্নে, পাল যুগের শেষভাগে গঠিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, হিন্দু ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র, যোগ সাধনা, নারীপুরুষের যৌথ সাধনা এবং গুরুতত্ত্ব—সব মিলিয়ে এক গূঢ় তাত্ত্বিক পথরেখা নির্মিত হয়েছে।

🔸 বাঙালির স্বাতন্ত্র্যচেতনা

চর্যাপদে বারবার উচ্চারিত হয়েছে সমাজ ও ধর্মের প্রচলিত ধারণার প্রতি সংশয় ও বিদ্রোহ। সিদ্ধাচার্যগণ ব্রাহ্মণ্য আচারনির্ভর ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনায় সরব। এক পদে বলা হয়েছে:

“জাহের বান চিহ্ণ রূপ ণ জানী
সো কইসে আগম বে এ বখানী”

অর্থাৎ যিনি বাহ্যিক চিহ্ন জানেন না, তিনি কীভাবে আগম বর্ণনা করতে পারেন?

এ ধরনের উচ্চারণ বাঙালির স্বাতন্ত্রচেতনা ও যুক্তিবাদী মানসিকতার প্রকাশ, যা পরবর্তীতে নবজাগরণ ও আধুনিকতাবাদের সূত্র ধরে আরও বিস্তার লাভ করে।

🔸 যুগসীমার পরিবর্তন

চর্যাপদের আবিষ্কারের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ শুরু হতো মনসামঙ্গল ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সময় থেকে (১৫শ শতাব্দী)। কিন্তু চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের সূচনাবিন্দুকে সরিয়ে দেয় ১০ম-১২শ শতকে, ফলে প্রায় আড়াই শতাব্দীর বিস্তার ঘটেছে সাহিত্যের ইতিহাসে। এটা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক মোড়বদল

🔸 পূর্ববঙ্গ ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার

চর্যাপদে বারবার পূর্ববঙ্গ বা বঙ্গালদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন ভুসুকুপাদ বলেন—
“আদি ভুসুক বঙ্গালি ভইলী”
এই ধরনের পদাংশ থেকে অনুমান করা যায় যে পূর্ববঙ্গ, বিশেষ করে বিক্রমপুর, কামরূপ, চট্টগ্রাম, ও রাজশাহী অঞ্চলে তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল।

চর্যাকারগণ—যেমন: ভুসুকুপাদ, কুক্কুরীপাদ, শবরপাদ, লুইপা—অনেকে বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ছিলেন। এটি বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারের প্রমাণ হিসেবে মূল্যবান।

🔸 সমাজচিত্র ও বর্ণব্যবস্থা

চর্যাপদ শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক দলিলও। পদগুলোতে সমাজের ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ও শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষীণ হলেও প্রতিবাদের সুর লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ:

“টালতো ঘর মোর নাহি পড়শেষী”
এখানে যে ‘ঘর’টির কথা বলা হচ্ছে, তা সমাজে স্থানহীন, একঘরে হয়ে যাওয়া মানুষের আশ্রয়হীনতাকে বোঝায়। এটি সামাজিক অসাম্য ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধচেতনা প্রকাশ করে।

🔸 তৎকালীন জীবনচিত্র ও লোকসংস্কৃতি

চর্যাপদে বিভিন্ন প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে তৎকালীন বাংলার লোকজীবনের চিত্র আঁকা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য চিত্রাবলি:

  • নদীপথ, খেয়াঘাট ও সাঁকো পারাপার
  • নৌকার কাঠামো (পাতি, দাঁড়, বঁইচি)
  • মেলা, আমোদ-প্রমোদ, শুঁড়িখানা, পানভোজন
  • পোশাক পরিচ্ছদ, গীত-নৃত্য-নাট্য

এইসব চিত্র বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির আদি রূপ সম্পর্কে গবেষণার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

🔸 গুরুবাদ ও আধ্যাত্মিক অন্বেষা

চর্যাপদে গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুক্কুরীপাদ বলেন—

“কোটি জনে এক জন বুজে”—
অর্থাৎ কোটি মানুষের মাঝে একজনই গূঢ়ার্থ অনুধাবন করতে সক্ষম। এই উপলব্ধি সম্ভব শুধু গুরুর আশ্রয়ে। সাধক ও গুরু—এই সম্পর্ক চর্যাপদে আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

✅ উপসংহার

চর্যাপদ নিছক একটি সাধনসঙ্গীতের সংকলন নয়; এটি বাংলার ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বিত দলিল। বৌদ্ধ সহজযান থেকে শুরু করে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের প্রভাব, বাঙালির ধর্মবোধ, জীবনযাত্রা, স্বাতন্ত্রচেতনা ও প্রতিরোধের মৃদু সুর—সব মিলিয়ে চর্যাপদ একটি ঐতিহাসিক আলোকস্তম্ভ

চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সূতিকাগার তো বটেই, সেইসাথে প্রাচীন বঙ্গের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনচিত্রের এক অবিনশ্বর দলিল। এ কারণেই এর অধ্যয়ন শুধু সাহিত্যিক নয়, বরং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গবেষণার অপরিহার্য অংশ।

📚 রেফারেন্স

  1. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, Buddhist Mystic Songs (Charyapada)
  2. ড. নীহাররঞ্জন রায়, Bangalir Itihas: Adi Parva
  3. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, The Origin and Development of the Bengali Language
  4. রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, চর্যাপদ: রচনাশৈলী ও সাধনা
  5. সৈয়দ আলাউদ্দিন, চর্যাপদ: ধর্ম ও ইতিহাসের আলোকছায়া

 

 


📎 @munshi.academy | 🌐 www.munshiacademy.com | 🎙️ গবেষণা ও বর্ণনা: মুনশি আলিম

 

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদ-বাংলা-সাহিত্যের/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *