✍️ চর্যাপদের ছন্দ ও অলংকার

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। এটি কেবল সাহিত্যিক সম্পদ নয়, বরং বাংলা কাব্যধারার জন্মলগ্নের এক অনন্য রূপ। চর্যাপদের ভাষা, ভাব ও অলংকার ব্যবহার বাংলা কাব্যের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে। চর্যাপদে ছন্দের ছায়া, অলংকারের চর্চা ও বোধ-দর্শনের গূঢ়তা এক অনন্য মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক পরিণত পর্যায়ের সূচনা করে।
🔠 ছন্দরীতি: ছন্দের আদিসূত্র
চর্যাপদের ছন্দ কোনো একক ছন্দ নয়; বরং সেখানে দেখা যায় পয়ার, ত্রিপদী, মাত্রাবৃত্ত, এবং পাদাকুলক ছন্দের প্রয়োগ। বেশিরভাগ পদেই ১৬ মাত্রার ছন্দ লক্ষ্য করা যায়, যার দুটি ভাগ (৮+৮ মাত্রা) দ্বারা গঠিত হয় একেকটি পংক্তি।
ড. সুকুমার সেন তাঁর “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” গ্রন্থে বলেন—
“চর্যার পদের মধ্যে ছন্দের প্রাথমিক প্রয়োগ দেখা যায়, যেটি পরে পয়ার ও ত্রিপদীর রূপে পরিণত হয়।”
উদাহরণস্বরূপ চর্যাপদের একটি লাইন লক্ষ করা যাক—
📝 “চরি গচি মাগু পুণ্ডরী কা, সঙ্ঘ বুদ্ধ গিনা” (ভুসুকুপা)
এখানে ৮+৮ মাত্রার ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও সব পদেই এই নির্ধারিত মাত্রা নেই, কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে, চর্যাচার্যগণ কাব্যের গীতিময়তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
চর্যায় ছন্দের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো— ছন্দপংক্তির পর্বসংখ্যাগত বৈচিত্র্য। অর্থাৎ, ছন্দ কখনও তিন পর্বে বিভক্ত, কখনও চার পর্বে। এই বৈচিত্র্য চর্যাকে একাধারে সরল ও গভীর করে তোলে।
🎵 অলংকার: গূঢ় ভাবের সৌন্দর্য
চর্যাপদে অলংকারচর্চাও ছিল চিন্তাশীল ও সজীব। বিশেষত অনুপ্রাস, অন্ত্যানুপ্রাস, রূপক, প্রতীক, ও প্রস্তার অলংকার লক্ষ করা যায়। প্রায় প্রতিটি পদেই অন্ত্যমিল দেখা যায়, যা বাংলা কাব্যের সংগীতধর্মিতার সূচনা করেছে।
উদাহরণস্বরূপ:
🗣️ “বাহ তু ডোম্বী, বাহ লো ডোম্বী, বাটত ভইলা উদারা।” (লুইপা)
এখানে “ডোম্বী”, “বাহ”, “উডারা” প্রভৃতি শব্দে ধ্বনির পুনরাবৃত্তি ছন্দের সংগীতধর্মিতা বৃদ্ধি করেছে।
চর্যাপদে রূপক ও প্রতীকচিত্র এতটাই গূঢ় যে বহুবছর এই কাব্যগুলো সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য রয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ‘ডোম্বী’ শব্দটি গোপন তান্ত্রিক সাধনার এক নারীবাদী প্রতীক, যা বহুমাত্রিক অর্থবহন করে। আবার, ‘পিঙলা’, ‘গজ’, ‘হংস’ ইত্যাদি প্রতীক ধর্মতাত্ত্বিক বোধ প্রকাশ করে।
চর্যার অলংকার কেবল কাব্যিক সৌন্দর্যের উপাদান নয়, বরং তা গূঢ় বৌদ্ধবোধ, সহজযান ও মহাসূত্র তত্ত্বকে আড়াল ও উপস্থাপন করার একটি সাংকেতিক উপায়।
📜 ভাষা ও অলংকারের কৌশল: গোপন ভাবের পর্দা
চর্যাচার্যগণ সাধনা ও তত্ত্ব গোপন রাখতে একধরনের সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেছেন— যাকে বলা হয় সান্ধ্যভাষা বা সান্ধ্যভাষ্য। ড. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন—
“চর্যাগান ছিল সহজযানী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের আত্মবিকাশের ধ্বনি, যা গূঢ় অর্থে পরিপূর্ণ।”
এই গূঢ় ভাব প্রকাশে অলংকার ও ছন্দ ছিল নিখুঁত অস্ত্র। পদগুলি সুরে গীত হত, তাই সংগীতপ্রবণ ধ্বনি ও অনুপ্রাস ব্যবহার ছিল স্বাভাবিক।
🧭 প্রভাব ও পরবর্তীকালের সম্পর্ক
চর্যাপদের ছন্দ ও অলংকার শুধু প্রাচীন নিদর্শন নয়— এটি বাংলা কাব্যচর্চার মূল উৎসধারা। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী, মধ্যযুগীয় সংগীত—সব ক্ষেত্রেই চর্যার ছায়া স্পষ্ট।
ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিশ্লেষণে বলেন—
“চর্যাগানেই সর্বপ্রথম পয়ার-ত্রিপদীর আদিসুর ধ্বনিত হয়েছে। এমনকি জয়দেবের গীতগোবিন্দেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত।”
পদাবলীর গীতিক ছন্দ, অন্ত্যমিল, এবং অলংকারচর্চা—সব চর্যার সংগীত ও ভাবরীতির ধারাবাহিকতা।
🔍 উপসংহার
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যরূপ। তার ছন্দে প্রাচীন গীতির ছোঁয়া, অলংকারে ধ্বনি ও ভাবের গূঢ়তা। এ পদগুলি শুধু ধর্মীয় সাধনার ভাষ্য নয়, বরং বাংলা কবিতার গঠনমূলক বিকাশের এক ঐতিহাসিক রূপান্তর। চর্যাচার্যদের এই রচনার মাধ্যমেই বাংলা কাব্যসাহিত্যের ছন্দ, অলংকার ও ভাবরীতির প্রথম রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
📚 তথ্যসূত্র:
- সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড।
- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, চর্যাপদ ও তার তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত, বিশ্বভারতী।
- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (সম্পাদনা)।
- নজরুল ইসলাম, বাংলা ছন্দের বিবর্তন।
https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-ছন্দ-ও-অলংকার/