
🕰️ চর্যাপদের রচনাকাল
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই মতপার্থক্য রয়েছে। ভাষা, ধর্ম, দর্শন এবং ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী চর্যার বিভিন্ন গীতির সময়কাল নির্ধারণে ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিতগণ এটি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত বলে একমত।
📚 গবেষকদের মতভেদ
🔸 সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী মনে করেন, চর্যার পদসমূহ খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত।
🔸 অপরদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে চর্যাপদের রচনাকাল খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মত দেন।
📌 ইতিহাস ও কিংবদন্তির ভিত্তিতে সময় নির্ধারণ
🔹 হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, চর্যাগীতির অন্যতম কবি লুইপা ছিলেন অতীশ দীপঙ্করের সমসাময়িক (৯৮০–১০৫৩ খ্রি.)। তিনি বলেন, অতীশের তিব্বত যাত্রার আগে লুইপা তাঁকে সহায়তা করেছিলেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে লুইপা দশম শতাব্দীর শেষভাগে জীবিত ছিলেন।
🔹 তবে তিব্বতি কিংবদন্তি মতে, লুইপা ছিলেন সিদ্ধাচার্যদের আদি গুরু। সুতরাং, চর্যাপদের কিছু পদ দশম শতাব্দীর পূর্বেও রচিত হয়ে থাকতে পারে না।
🏛️ ঐতিহাসিক গ্রন্থপত্রের উল্লেখ
🔸 কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত “হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা” নামে এক বৌদ্ধতান্ত্রিক পুঁথি পাল রাজা গোবিন্দপালের (শাসনকাল: ১১৫৫ খ্রি.) সময়ের দলিল।
🔸 গবেষকদের মতে, এই পুঁথির রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণাচার্যই ছিলেন চর্যাপদের কবি কাহ্নপাদ।
🔸 নাথ সাহিত্য অনুসারে, কাহ্নপাদের গুরু জালন্ধরিপাদ (হাড়িপা) ছিলেন গোরক্ষনাথের শিষ্য।
🔸 মারাঠি গ্রন্থ ‘জ্ঞানেশ্বরী’ (১২৯০ খ্রি.) অনুযায়ী, লেখক জ্ঞানদেব দীক্ষা পান নিবৃত্তিনাথের নিকট থেকে, যিনি ছিলেন গোরক্ষনাথীয় বংশের।
🔸 এই তথ্যসমূহ থেকেও বোঝা যায়, কাহ্নপাদ দ্বাদশ শতকের একজন কবি ছিলেন।
📖 নব চর্যাপদের আবিষ্কার
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে গবেষক শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে শতাধিক নতুন চর্যাগান সংগ্রহ করেন।
🔹 এগুলো ১৯৮৯ সালে “নব চর্যাপদ” নামে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়।
🔹 এই নতুন পদগুলি চর্যাগান রচনার ধারাবাহিকতা এবং দ্বাদশ শতকের পরেও চর্যা রচনার প্রচলন ছিল তা প্রমাণ করে।
✅ উপসংহার
🔹 ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস ও সাহিত্য বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে চর্যাগানসমূহ মূলত খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত।
🔹 তবে চর্যার রচনার সূচনা বা ধারাবাহিকতা সপ্তম শতক থেকে শুরু হয়ে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতে পারে।
🔹 এই দীর্ঘ সময় ধরে রচিত চর্যাগান বৌদ্ধ সাহিত্যের অন্তর্গত হলেও এতে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন সমাজ, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য প্রকাশ।
https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-রচনাকাল/