চর্যাপদের নামকরণ

আবিষ্কৃত পুঁথিতে চর্যাগানসমূহের যে নাম উল্লেখিত রয়েছে, তা হলো “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”। এই নামেই মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তবে পরবর্তীতে এই নাম নিয়েই গবেষকদের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামটির উৎস ও বিতর্ক

মূল পুঁথিটি নেপালের রাজদরবারে সংরক্ষিত ছিল এবং এটি একটি অনুলিপি বা নকল পুঁথি। ফলে প্রকৃত বা মূল পুঁথির নাম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। এই অনিশ্চয়তার কারণে চর্যাগীতির সঠিক নাম নিয়ে পণ্ডিতসমাজে নানা মতের উদ্ভব ঘটে।

• বিধুশেখর শাস্ত্রী ১৯২৮ সালে চর্যার প্রথম পদের সংস্কৃত টীকার একটি শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করেন, যেখানে উল্লেখ ছিল:
  

  “শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্যচর্যাচয়ে।
  সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মল গিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।”

  তাঁর মতে, এখানে ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’ শব্দগুচ্ছটিই প্রকৃত নাম, যা পুথি-নকলকারীর ভুলে ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, তিনি “আশ্চর্যচর্যাচয়” নামটিকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন।

• এই মতের বিরোধিতা করে আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং বলেন, এটি একটি আধুনিক ব্যাখ্যা মাত্র।
• প্রবোধচন্দ্র বাগচী মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ নামটির পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” ও “আশ্চর্যচর্যাচয়” — এই দুই শব্দের সংমিশ্রণে একটি যৌগিক নাম গ্রহণের পক্ষে যুক্তি দেন।
• তবে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত খণ্ডন করে বলেন,
  

  “‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ নামটি আধুনিক পণ্ডিতদের কল্পিত একটি ‘জোড়কলম’ শব্দ। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।”

চর্যাগীতিকোষ নামক অনুমান

আধুনিক গবেষকগণ তিব্বতি গ্রন্থসম্ভার (বিশেষত Bastan-hgyar গ্রন্থমালা) থেকে ধারণা করেন, মূল চর্যাপদের গ্রন্থের নাম ছিল “চর্যাগীতিকোষ”। এই পুঁথির জন্য লেখা সংস্কৃত টীকাটির নাম ছিল “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” — যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত অনুলিপি পুঁথির নাম।
অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত সমর্থন করেন এবং বলেন, চর্যাচর্যবিনিশ্চয় আসলে চর্যাগীতিকোষের টীকাগ্রন্থ মাত্র।

উপসংহার

চর্যাপদের নামকরণ সম্পর্কে এখনো গবেষকদের মধ্যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তবে ইতিহাস ও তত্ত্বের ভিত্তিতে ‘চর্যাগীতিকোষ’কে মূল গ্রন্থ এবং ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’-কে তার টীকা হিসেবে ধরা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রচেষ্টায় আজও এই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হিসেবে সমাদৃত।

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদের-নামকরণ/ ‎