চর্যাপদ: প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় সূচনাপর্ব

Spread the love
চর্যাপদ
চর্যাপদ

চর্যাপদ: প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় সূচনাপর্ব

চর্যাপদ বা চর্যাগীতি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এটি মূলত বৌদ্ধ সহজযান ধর্মপন্থী সিদ্ধাচার্যদের রচিত দার্শনিক দোঁহা বা গীতিগুচ্ছ, যেখানে ধর্মীয় সাধনার পাশাপাশি প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন সমাজের নানা দিক।

রচয়িতা ও গঠন

চর্যাপদে মোট ২৪ (মতান্তরে ২৩) জন সিদ্ধাচার্যের লেখা ৪৬টি সম্পূর্ণ১টি খণ্ডিত গান রয়েছে। পরবর্তীতে তিব্বতি অনুবাদের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে, মূল পুঁথিতে ৫১টি গান ছিল।

ধর্মীয় প্রভাব

চর্যাপদ বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষত তান্ত্রিক সহজযান শাখার অন্তর্গত সাধনা ও তত্ত্বকে কেন্দ্র করে রচিত। এতে গূঢ় তত্ত্বধারণা রূপক, প্রতীক ও লৌকিক চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। সিদ্ধাচার্যগণ আধ্যাত্মিক মুক্তি ও চৈতন্যলাভের উপায় হিসেবে মানবদেহকেই মন্দির রূপে কল্পনা করেন, যা বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সামাজিক প্রভাব

চর্যাপদে বর্ণিত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন, কৃষক, মৎস্যজীবী, জেলে, নাপিত, বেশ্যা প্রভৃতির বাস্তবচিত্র। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, চর্যাগীতি শুধুই ধর্মীয় রচনা নয়, বরং একটি সামাজিক দলিল, যা প্রাচীন বাংলার জনজীবনের বৈচিত্র্য তুলে ধরে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

চর্যাপদের রচনাকাল (৮ম–১২শ শতক) ছিল পাল ও সেন রাজাদের যুগ। পালরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। ফলে চর্যাগীতি রচনার পেছনে বৌদ্ধধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সময়ে বৌদ্ধ চিন্তা-চেতনা কেবল ধর্মীয় নয়, রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আবিষ্কারের ইতিহাস

চর্যাপদের আবিষ্কার ছিল বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা।

  • ১৮৯৭, ১৮৯৮ ও ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিনবার নেপাল সফর করেন বৌদ্ধ পুঁথি অনুসন্ধানে।
  • ১৯০৭ সালের সফরে নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরি থেকে “চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়” নামক একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন, যাতে ৪৭টি গান ছিল।
  • এই পুঁথির ভাষা ছিল অপভ্রংশমিশ্রিত প্রাচীন বাংলা, যা বাংলা ভাষার আদি রূপ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
  • ১৯১৬ সালে এটি “হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোঁহা” নামে প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে।

পুঁথির বৈশিষ্ট্য ও ভাষা

  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথমে সব গানকেই প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত বলে ধারণা করেন, কিন্তু পরে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রবোধচন্দ্র বাগচী প্রমাণ করেন যে কেবল চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় পুঁথির ভাষা বাংলা; বাকি কিছু পুঁথির ভাষা ছিল পশ্চিম অপভ্রংশ।
  • তিব্বতি অনুবাদে মূল গানের শেষাংশসহ আরও কিছু গান পাওয়া যায়, যা থেকে মোট গানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১টি।

চর্যাপদের গুরুত্ব

  • বাংলা সাহিত্যের সূচনা লগ্নকে চিহ্নিত করে।
  • এটি ধর্ম, সাহিত্য ও সমাজের মেলবন্ধন।
  • এতে প্রাপ্ত ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বাংলা ভাষার শিকড় অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সরবরাহ করে।

উপসংহার:
চর্যাপদ শুধু সাহিত্য নয়, এটি বাংলা জাতির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয়, ধর্মীয় দর্শন এবং সমাজচিত্রের এক অনন্য দলিল। বৌদ্ধ সাধনা, প্রাক-আধুনিক বাংলার জীবনধারা এবং ভাষার বিবর্তন—সবই এতে একীভূত হয়েছে।

 

https://www.munshiacademy.com/চর্যাপদ-প্রাচীন-বাংলা-সা/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *