
হুমায়ূন আজাদ : জীবন ও সাহিত্যকর্ম
🧭 জীবন পরিচিতি
হুমায়ূন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ – ১২ আগস্ট ২০০৪) ছিলেন বাংলা ভাষার এক প্রথাবিরোধী সাহিত্যিক, কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক ।
তিনি রাড়িখাল (বর্তমান মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, পিতা আব্দুর রাশেদ শিক্ষক ও পোস্টমাস্টার এবং মাতা জোবেদা খাতুন গৃহিণী ছিলেন ।
📚 শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন
- মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন থেকে (১৯৬২) ।
- ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অনার্স (১৯৬৭) ও এমএ (১৯৬৮) ডিগ্রি অর্জন করেন ।
- পরবর্তীকালে কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে ১৯৭৬ সালে এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন ।
- কর্মজীবন শুরু করেন চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে, এরপর চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন ।
🖋️ সাহিত্যকর্ম ও বৈশিষ্ট্য
- আজাদ ৬০–৭০টির অধিক গ্রন্থ রচনা করেন – কাব্য, উপন্যাস, সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান, কিশোর সাহিত্যসহ ।
- উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে–
- ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৩)
- ‘Chhappanno Hajar Borgomail’ (১৯৯৪) – সামরিক শাসন ও সামরিক শাসনের সমালোচনা করে
- ‘Pak Sar Jamin Sad Bad’ (২০০৪) – ধর্মীয় মৌলবাদের প্রকাশ্য সমালোচনা
- ‘নারী’ (Naree, ১৯৯২) – বাংলা ভাষায় নারীবাদ নিয়ে প্রথম মূলতঃ গবেষণা-গ্রন্থ, ১৯৯৫ সালে নিষিদ্ধ হয়, ২০০০ সালে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয় ।
ভাষাবিজ্ঞান গবেষণা
১৯৬০-এর দশকে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্স্কি-উদ্ভাবিত রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল প্রোনোমিনালাইজেশান ইন বেঙলি (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তীতে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে একই শিরোনামের এটি ইংরেজি ভাষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব নামে একটি বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করেন। একই সালে বাংলা একাডেমি থেকে তিনি বাঙলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালীলিক সঙ্কলন প্রকাশ করেন, যাতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত। তিনি পরবর্তীকালে তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮) ও অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯) শিরোনামে দুইটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে মৃত্যুর কারণে তার এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হয় নি।
প্রবন্ধ
বিশ্বাস ও দর্শন
আজাদ ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং তিনি সরাসরি ধর্মের সমালোচনা করে লেখেননি তবে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করতেন এবং এটি বিভিন্ন ভাবে তার লেখায় প্রকাশ পেয়েছে।[৩৮] তিনি বাংলাদেশের সমাজে চলা রক্ষণশীলতা এবং প্রথার বিরোধিতা করতেন।[৩৯] সর্বপ্রথম গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের আদলে ১৯৯১ প্রকাশিত প্রবচনগুচ্ছ ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদের লেখালেখিতে উদারপন্থা, বিজ্ঞানমনস্কতার[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এবং একই সঙ্গে দ্রোহের ছাপ স্পষ্ট ছিলো। একটি বৈষম্যহীন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার স্বপ্ন তিনি দেখতেন। তিনি তার লেখনীতে প্রকাশ করেছিলেন,
আমি এমন একটি সমাজ চাই যে সমাজ বলা যাক পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজের চূড়ান্ত রূপ। সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে বিভোর আমি নই, আমি চাই সবাই সচ্ছল থাকবে – জ্ঞানচর্চা, আনন্দ, উল্লাস এবং যতপ্রথা রয়েছে সেসব অতিক্রম করে মানুষ সম্পূর্ণ মানবিক জীবন যাপন করবে।[বিদ্র ৬]
রাজনৈতিক-সামাজিক সমালোচনা
১৯৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ুন আজাদ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। এ সময় তিনি খবরের কাগজ নামীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা দিয়ে তার রাজনৈতিক লেখালিখির সূত্রপাত। মাতাল তরণী (১৯৯২) ছিলো তার রাজনৈতিক-সমাজ সমালোচনার সংকলনগ্রন্থ।
🛡️ প্রতিপক্ষ ও হামলার ঘটনায় মৃত্যু
২০০৪ সালের বইমেলায় ‘Pak Sar Jamin Sad Bad’ প্রকাশিত হওয়ার পর মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন আজাদ। ২৭ ফেব্রুয়ারি তাকে বাংলা একাডেমির বাইরে হামলা করা হয়, সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি ও থাইল্যান্ডে পাঠানো হয় ।
পরবর্তীতে ১১ আগস্ট ২০০৪ (মিউনিখ, জার্মানি) তিনি আকস্মিকভাবে মারা যান ।
🏅 সম্মাননা ও প্রভাব
- ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য ।
- ২০১২ সালে মৃত্যুর পর একুশে পদক লাভ করেন সর্বোত্তম ভাষা ও সাহিত্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ।
- আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা, নারীবাদ ও যুক্তিবাদ নিয়ে তাঁর ভাবনা ও লেখনী আজও শিক্ষা ও সমালোচনার বিষয় ।
🎯 উপসংহার
হুমায়ূন আজাদ ছিলেন কেবল একজন সাহিত্যিক নয়, বরং একটি চলমান আন্দোলন — ধর্ম এবং প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, নারীবাদের পক্ষে, সাম্য ও মুক্তচিন্তার অধিকর্ত্তা। তাঁর সাহিত্যে নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সমাজরূপ গ্রহণ করেই লেখা হয়েছে, যা শিক্ষিত‐আলোকিত পাঠক সমাজে অম্লান প্রভাব রেখে গেছে। তাঁর সাহিত্য আজও দেশ ও সমাজ বিবেক জাগ্রত করে রাখে।
https://www.munshiacademy.com/হুমায়ূন-আজাদ-জীবন-ও-সাহি/