রাজনারায়ণ বসু : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love
রাজনারায়ণ বসু
রাজনারায়ণ বসু

 

🔷 রাজনারায়ণ বসু : জীবন ও সাহিত্যকর্ম 🔷

উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ রাজনারায়ণ বসু একাধারে ছিলেন চিন্তাবিদ, সমাজসংস্কারক ও সাহিত্যিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ রোপণের পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি শুধু কাব্য অনুবাদেই থেমে থাকেননি, বরং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা ও সমাজসংস্কারে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

🔸 জন্ম ও শিক্ষাজীবন

রাজনারায়ণ বসু জন্মগ্রহণ করেন ১৮২৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, বোড়াল গ্রামে (বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ)। তার পূর্বপুরুষদের আদিনিবাস ছিল গড় গোবিন্দপুর, কলকাতা। শৈশবকাল থেকেই তিনি বিদ্যাশিক্ষায় অনুরাগী ছিলেন এবং পরে সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।

🔸 ব্রাহ্ম আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদ

তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন, যার ফলে তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সমাজ তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়। ব্রাহ্ম সমাজের আদর্শ প্রচারে তিনি সক্রিয় হন। ১৮৭৩ সালে ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি পাশ্চাত্য মতবাদের বিরুদ্ধতা করে হিন্দু ধর্মের গৌরব ব্যাখ্যা করেন। ১৮৮৭ সালে তাঁর রচিত “বৃদ্ধ হিন্দুর আশা” পুস্তিকায় জাতীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন, যা পরবর্তীকালে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

🔸 সমাজ সংস্কারে অবদান

রাজনারায়ণ বিধবাবিবাহকে সমর্থন করেন এবং সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ১৮৬০ সালে ‘মদ্যপান নিবারণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা তৎকালীন সমাজে মাদকবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোগ। পাশাপাশি তিনি শিক্ষার প্রসারে গ্রন্থাগার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন, বিশেষত মেদিনীপুর জেলায়।

🔸 সাহিত্যসাধনা ও অনুবাদ

তিনি ছিলেন সাহিত্যিক হিসেবেও অগ্রণী। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ কাব্য” তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এছাড়াও উপনিষদ অনুবাদ, সমাজ ও ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা এবং প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে তিনি এক বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার রেখে যান।

🔸 উল্লেখযোগ্য রচনা

📘 রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা (১৮৫৫, ১৮৭০)
📘 ব্রাহ্ম সাধন (১৮৬৫)
📘 ধর্মতত্ত্বদীপিকা (১৮৬৬–৬৭)
📘 হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা (১৮৭৩)
📘 সেকাল আর একাল (১৮৭৪)
📘 বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮)
📘 বৃদ্ধ হিন্দুর আশা (১৮৮৭)
📘 রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত (প্রকাশিত: ১৯০৯)

🔸 পরিবার ও উত্তরসূরী

তিনি ছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্র নাথ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র, যিনি ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে হত্যা করার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন। রাজনারায়ণের পুত্র রাজা বসুও সাহিত্য ও সমাজকর্মে পরিচিত ছিলেন।

🔸 পরিণত জীবন ও মৃত্যু

জীবনের শেষ পর্যায়ে রাজনারায়ণ বসু নিজের স্মৃতিকথা রচনায় মন দেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর চিন্তা, সাহিত্য ও সমাজসংস্কারের প্রেরণা আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রণম্য।

🔸 উপসংহার

রাজনারায়ণ বসু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শুধু একজন সাহিত্যিক নন—তিনি ছিলেন এক জাতীয় চেতনার জাগরণদূত। সাহিত্য ও সংস্কারে তাঁর কাজ পরবর্তী প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে অনন্তকাল।

 

 

 

https://www.munshiacademy.com/রাজনারায়ণ-বসু-জীবন-ও-সাহ/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *