মীর মশাররফ হোসেন: একজন পথিকৃৎ বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক

মীর মশাররফ হোসেন (১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ – ১৯ ডিসেম্বর ১৯১২) ছিলেন একজন প্রভাবশালী বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের মধ্যে তিনি অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত। ‘বিষাদ সিন্ধু’ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, যা কারবালার ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত।
জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
মীর মশাররফ হোসেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন, এক সম্ভ্রান্ত জমিদার। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদী গ্রামে। তাঁর মাতার নাম ছিল দৌলতুন্নেছা।
শিক্ষাজীবন
তিনি কুষ্টিয়ার বিভিন্ন পাঠশালা, পদমদী নবাব স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। তাঁর আত্মজীবনীতে জগমোহন নন্দীর পাঠশালার কথা উল্লেখ আছে। শিক্ষাজীবনেই তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা প্রকাশ পেতে শুরু করে।
সাহিত্যকর্ম ও অবদান
মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের পথিকৃৎ। তিনি উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, প্রবন্ধ ও কাব্যসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলি বাংলা গদ্য সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে।
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ:
- রত্নবতী (১৮৬৯): বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম উপন্যাস।
- বসন্তকুমারী নাটক (১৮৭৩): মুসলিম সাহিত্যিক রচিত প্রথম নাটক।
- বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫–১৮৯১): তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, তিন পর্বে বিভক্ত।
- উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০): আত্মজৈবনিক উপন্যাস।
- জমিদার দর্পণ, এর উপায় কী?, বেহুলা গীতাভিনয়, গো-জীবন, আমার জীবনী ইত্যাদি।
তিনি ‘সঙ্গীত লহরী’, ‘মৌলুদ শরীফ’, ‘মোসলেম বীরত্ব’, ‘এসলামের জয়’, ‘মদিনার গৌরব’ প্রভৃতি ধর্মীয় ও কাব্য রচনা করেন। তাঁর রচনায় সমাজসংস্কার, মানবতা, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বাংলাভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ফুটে ওঠে।
‘গো-জীবন’ বিতর্ক
১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘গো-জীবন’ প্রবন্ধে তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, গরু কোরবানি ইত্যাদি প্রসঙ্গে যুক্তিসংগত ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মত দেন। এতে তিনি গরুর পরিবর্তে ছাগল কোরবানি করার পক্ষে মত দেন। এই প্রবন্ধের জন্য তাঁকে প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়।
ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যু
মাত্র ১৮ বছর বয়সে আজিজুন্নেসার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করেন ও কিছুদিন কলকাতায় বসবাস করেন। ১৯ ডিসেম্বর ১৯১২ সালে পদমদীতে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাঁর কবর ও ‘মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কমপ্লেক্স’ অবস্থিত।
মূল্যায়ন
বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন এক অনন্য আলোচক ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন লেখক। সমাজ ও ধর্মের জটিল প্রশ্নে যুক্তিনিষ্ঠ মত পেশ করায় তিনি একাধারে আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অংশগ্রহণের একটি ভিত্তি নির্মাণ করেছে।
সম্মাননা
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি আবাসিক হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (১৯৭৮)।
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁকে পথিকৃৎ মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
https://www.munshiacademy.com/মীর-মশাররফ-হোসেন-জীবন-ও-সা/