ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love

🖋️ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: জীবন ও সাহিত্যকর্ম

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, Ishwarchandra_Vidyasagar
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, Ishwarchandra_Vidyasagar

🔹 পূর্ণ নাম: ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বিদ্যাসাগর উপাধি পরে প্রাপ্ত)
🔹 জন্ম: ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০
🔹 জন্মস্থান: বীরসিংহ গ্রাম, মেদিনীপুর, বঙ্গ প্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
🔹 মৃত্যু: ২৯ জুলাই ১৮৯১, কলকাতা
🔹 পরিচিতি: সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, লেখক, পাণ্ডিত্যের জন্য পরিচিত
🔹 উপাধি: ‘বিদ্যাসাগর’ — সংস্কৃত পাণ্ডিত্যের জন্য দেওয়া হয়

🧬 জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি

🔸 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভাগবতী দেবী।
🔸 তাঁর জন্ম হয় এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে।
🔸 ছোটবেলায় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই তাঁকে পড়াশোনা করতে হয়েছে।
🔸 পড়াশোনার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ও অধ্যবসায় তাঁকে এক অসাধারণ পণ্ডিত হিসেবে গড়ে তোলে।

🎓 শিক্ষাজীবন

🔹 ছোটবেলায় বীরসিংহ থেকে কলকাতায় আসেন শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে।
🔹 ভর্তি হন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে
🔹 সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, তৎসম ও বিভিন্ন শাস্ত্রজ্ঞানে অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন।
🔹 সংস্কৃত কলেজ থেকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন ১৮৪১ সালে।

🏫 কর্মজীবন ও শিক্ষা সংস্কার

🔸 ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু।
🔸 পরে প্রিন্সিপাল এবং শিক্ষা দপ্তরের বিশেষ পরিদর্শক হন।
🔸 বাংলায় বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রদূত।

📌 শিক্ষা সংস্কারে অবদান:

  • নারী শিক্ষাশিশুশিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা
  • আধুনিক পাঠ্যক্রম প্রবর্তন, যেমন— বাংলা ভাষায় গণিত, বিজ্ঞান ও ইতিহাস শিক্ষা
  • বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে বাঙালি শিশুদের উপযোগী পাঠ্যবই প্রণয়ন
  • বর্ণপরিচয়কথামালা-র মতো পাঠ্যবই শিশুদের পাঠে সহজ ও আনন্দদায়ক করে তোলে

⚖️ সমাজ সংস্কার

🔹 বিধবাবিবাহ প্রচলন: তাঁর সবচেয়ে যুগান্তকারী অবদান ছিল হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ আইন (১৮৫৬) কার্যকর করার জন্য কঠোর সংগ্রাম।
🔹 বাল্যবিবাহ বিরোধিতা: বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতা তৈরি করেন।
🔹 বহুবিবাহ বিরোধিতা: নারীর সম্মান ও অধিকার রক্ষায় কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন।
🔹 সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে তার অবদান আজও চিরস্মরণীয়।

শিক্ষা সংস্কার

১৮৩৯ সালে জ্ঞানচর্চায় তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনে প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃৃত কলেজ ত্যাগ করে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান শিক্ষকের পদ লাভ করেন। ১৮৪৬ সালে সংস্কৃৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ওই কলেজের শিক্ষকদের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন। ১৮৪৯ সালে মার্শম্যানের ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল’ অবলম্বনে রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’ গ্রন্থখানি। ওই বছরই ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন ‘সব শুভকরী সভা’। ১৮৫০ সালে তিনি সংস্কৃৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৩৫ সংবৎ (১৮৭৪) প্রকাশিত ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থের ৫৩তম সংস্করণ। বাংলা বর্ণশিক্ষার জগতে ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত বইটি সার্ধশত বছর পরে আজও সমান জনপ্রিয়। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় ‘সব শুভকরী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ সালে জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হলে তার সদস্য মনোনীত হন বিদ্যাসাগর।

১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর তখনই তিনি নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় স্কুুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দুবছরের মধ্যে তিনি কুড়িটি স্কুুল স্থাপন করেন। এ ছাড়া তিনি এসব স্কুুলে পড়ানোর জন্য, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুুল স্থাপন করেন। তিনি নিজ গ্রামে নিজ খরচে একটি স্কুুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হয়। ১৮৫৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। ওই বছর ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়। ওই বছর ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ দেওয়া হয়। ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন বিদ্যাসাগর। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশ করেন ‘সোমপ্রকাশ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যেখানে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৬১ সালের এপ্রিলে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুুলের সম্পাদক মনোনীত হন বিদ্যাসাগর। এই বছর ডিসেম্বরে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার পরিচালনার ভার নেন তিনি। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন বিদ্যাসাগর। ওই বছর মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। ১৮৬৪ সালের ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর। ১৮৬৭ সালের জুলাইয়ে জ্যেষ্ঠ কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদক পদ ত্যাগ করেন। ১৮৭০ সালের জানুয়ারিতে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর। ১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮৭৪ সালে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গণনানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি বিদ্যাসাগর মহাশয় সিআইই উপাধি পান। ১৮৮৭ সালে মেট্রোপলিটান কলেজ স্থানান্তরিত হয়। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই (১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৩ শ্রাবণ)।

বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষামূলক গ্রন্থ : ‘বর্ণপরিচয়’ (১ম ও ২য় ভাগ, ১৮৫৫), ‘ঋজুপাঠ’ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ, ১৮৫১-৫২), ‘সংস্কৃৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ (১৮৫১), ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ (১৮৫৩); অনুবাদ গ্রন্থ : হিন্দি থেকে বাংলা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭), সংস্কৃৃত থেকে বাংলা ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০), ‘মহাভারতের উপক্রমণিকা’ (১৮৬০), ‘বামনাখ্যানম্’ (১৮৭৩); ইংরেজি থেকে বাংলা ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮), ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯), ‘নীতিবোধ’ (১৮৫১), ‘বোধোদয়’ (১৮৫১), ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘চরিতাবলী’ (১৮৫৭), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬১); ইংরেজি গ্রন্থ : ‘পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্’, ‘সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ’, ‘সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার’; মৌলিক গ্রন্থ : ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩), ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫), ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭১), ‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪), ‘রত্নপরীক্ষা’ (১৮৮৬) প্রভৃতি।

চরিত্র

বিদ্যাসাগর ছিলেন তার আদর্শ রূপায়নের ক্ষেত্রে নির্মম, কঠোর ও আপোসহীন। বিবেকানন্দ ১৮৮৬ সালে বিদ্যাসাগর পরিচালিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের বৌবাজার শাখার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। কিন্তু কর্তব্যকর্মে অবহেলার কারণে একমাসের মধ্যেই সেখান থেকে বরখাস্ত হন। সে সময়ের বিখ্যাত বাগ্মী তথা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রগুরু বলে পরিচিত সুরেন্দ্রনাথকে তার অসুবিধার সময়ে চাকরি দিয়েছিলেন, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের নিষ্ঠার অভাব দেখে তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়েও দিয়েছিলেন। নিজের জামাই সূর্যকুমারকে স্কুলের দায়িত্ব থেকে এক কথায় অপসারিত করেন, বিদ্যালয় তহবিলে সামান্য গরমিল লক্ষ্য করে। পুত্র নারায়ন বিধবাবিবাহ করতে সম্মত হওয়াতে বিদ্যাসাগর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেও এই বিবাহ সম্পন্ন করেন। আবার যখন জানলেন পুত্র নারায়ন ‘যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী’ হয়েছেন তখন পুত্রের সাথে সমস্ত ‘সংস্রব ও সম্পর্ক’ পরিত্যাগ করেন। এই ধরনের মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্র ছিল কঠোর ও কোমলের সংমিশ্রণ। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন প্রবল জেদী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট মাথা নত করা থেকে কাজ থেকে অবসর নেওয়া তিনি শ্রেয় মনে করতেন। ইংরেজকেও তিনি প্রভুর দৃষ্টিতে দেখতেন না। তাদের সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে তার

কণ্ঠরোধ করা সম্ভবপর ছিল না। অন্যদিকে দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য সর্বদা তার হৃদয়ে সহানুভূতি পূর্ণ থাকত। তিনি দরিদ্রদের মনের ব্যথা অনুভবও করতে পারতেন। কেউ অর্থসংকটে পড়ে তার দরজায় এলে তিনি কখনোই তাকে শূন্য হাতে ফেরাতেন না। কত দরিদ্র ছাত্র তার অর্থে পড়াশোনা এবং খাওয়াপরা চালাত। দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অন্নসত্র খুলে সকলকে দুই বেলা খাওয়াতেন। একবার কয়েকজন অন্নসত্রে খিচুড়ি খেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি সকলকে দুইবেলা মাছ ভাত খাওয়ানোর নির্দেশ দেন। যাঁরা অন্নসত্রে খেতে লজ্জা পেতেন, তাদের বাড়িতে গোপনে চালডাল বা টাকাও পাঠাতেন। এজন্য কখনই তিনি লোকের দানের উপর নির্ভর করতেন না। সব খরচ নিজে দিতেন। মাইকেল মধুসূদন বিদেশে ঋণগ্রস্ত হয়ে যখন তার কাছে অর্থসাহায্য চান, তখন তার নিজের কাছে অর্থ ছিল না। তিনি ধার করেও মাইকেলকে সাহায্য করেন। কার্মাটারে সাঁওতালদের সঙ্গে বাস করতে গিয়ে তিনি তাদেরও হয়ে ওঠেন। তারাও নানাভাবে তার নিকট সাহায্য পেয়ে তাকে পরম শ্রদ্ধার আসনে স্থাপন করে। দেশের আপামর দরিদ্রসাধারণ সংস্কৃত শাস্ত্রবিশারদ বিদ্যাসাগরকে জানত দয়ার সাগর নামে।

 

মাতৃভক্তি ছিল তার চরিত্রে অন্যতম গুণ। মনে করা হয়, বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলন ও মুক্তচেতনার নেপথ্যে জননী ভগবতী দেবীর বিশেষ প্রেরণা ছিল। বীরসিংহ গ্রামে তিনি মায়ের নির্দেশে বিদ্যালয়, অবৈতনিক ছাত্রাবাস ইত্যাদি গড়েছিলেন। তার বিধবা বিবাহ প্রবর্তনেও এই গ্রাম্য মহিলার বিশেষ অবদান ছিল। তিনিই পুত্রকে আদেশ করেছিলেন, বিধবাদের দুঃখনিবৃত্তির বন্দোবস্ত করতে। সম্ভবত, এই মায়ের ডাকে একবার তিনি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দামোদর নদ সাঁতরেও পার হয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ

জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী

নাম রেখেছিলেন “ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়”। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এই প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION

We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established Courts of Judicature.
H.T. Prinsep
President
J.W.J. Ousely
Member of the Committee of Examination

This Certificate has been granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 Corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C. Sutherland
Secy To the Committee (পুরনো বানান অপরিবর্তিত)

সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন।

✍️ সাহিত্যকর্ম

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার

আধুনিক রূপকারদের অন্যতম।

📚 প্রধান সাহিত্যকর্ম:

  1. বর্ণপরিচয় (খণ্ড ১ ও ২) — শিশুদের জন্য সহজ ও বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক
  2. কথামালা — ছোটদের নৈতিক শিক্ষা ও সাধারণ জ্ঞানমূলক গল্পসংকলন
  3. শকুন্তলা (অনুবাদ) — কালিদাসের মূল সংস্কৃত নাটকের বাংলা অনুবাদ
  4. সীতার বনবাস — রামায়ণের একটি অংশের মানবিক রূপান্তর
  5. বেতালপঞ্চবিংশতি (অনুবাদ)
  6. সিংহলবিজয় (অনুবাদ)
  7. সীতার বনবাস
  8. বিদ্যাসাগর রচনাবলী — তার পূর্ণাঙ্গ গদ্যসাহিত্য সংকলন

🔸 ভাষাশৈলী: সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ও বাস্তবধর্মী
🔸 আন্দোলন: খাঁটি বাংলা গদ্য গঠনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য

অনুবাদ গ্রন্থ

  • হিন্দি থেকে বাংলা
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ ; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে)
  • সংস্কৃত থেকে বাংলা
  • শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪ ; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে)
  • সীতার বনবাস (১৮৬০) – ভবভূতির উত্তররামচরিতম্‌ নাটকের আখ্যানবস্তু।[২০]
  • মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০ ; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
  • বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩ ; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
  • ইংরেজি থেকে বাংলা
  • বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮ ; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
  • জীবনচরিত (১৮৪৯ ; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
  • নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব – ১৮৫১ ; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
  • বোধোদয় (১৮৫১ ; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
  • কথামালা (১৮৫৬ ; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
  • চরিতাবলী (১৮৫৭ ; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
  • ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯ ; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত)

ইংরেজি গ্রন্থ

  • পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্
  • সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ
  • সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার

মৌলিক গ্রন্থ

  • সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)
  • বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
  • বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩)
  • অতি অল্প হইল এবং ”আবার অতি অল্প হইল দুখানা পুস্তক (১৮৭৩, বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে।)
  • ব্রজবিলাস, যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য (নভেম্বর, ১৮৮৪) – “কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য” ছদ্মনামে রচিত। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের রচনার প্রত্যুত্তরে লিখিত হয়।[২১]
  • রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
  • প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ভবত ১৮৬৩)
  • জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
  • নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
  • ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)

সম্পাদিত গ্রন্থ

  • অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭)
  • কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ (১৮৫৩)
  • সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮)
  • শিশুপালবধ (১৮৫৩)
  • কুমারসম্ভবম্ (১৮৬২)
  • কাদম্বরী (১৮৬২)
  • বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২)
  • রঘুবংশম্ (১৮৫৩)
  • মেঘদূতম্ (১৮৬৯)
  • উত্তরচরিতম্ (১৮৭২)
  • অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (১৮৭১)
  • হর্ষচরিতম্ (১৮৮৩)
  • পদ্যসংগ্রহ প্রথম ভাগ (১৮৮৮ ; কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে সংকলিত)
  • পদ্যসংগ্রহ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০ ; রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল থেকে সংকলিত)

  🌟 দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন

🔹 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তা ছিল মানবিক, যুক্তিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ।
🔹 তিনি কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
🔹 ন্যায়, মানবতা ও নৈতিকতার পক্ষে তিনি ছিলেন আপসহীন।
🔹 সাধারণ মানুষের শিক্ষা, নারীর অধিকার ও সমাজের নৈতিক অগ্রগতিই ছিল তার আদর্শ।

🕯️ মৃত্যু

🔸 ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই, কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
🔸 মৃত্যুর পরও তার অবদান বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে জীবন্ত হয়ে রয়েছে।

🏅 উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন

🔹 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেই নয়, বাংলা সমাজের জাগরণ ও রূপান্তরেও তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক।
🔹 তাঁর নামে বহু প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, পুরস্কার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজও তাঁর স্মৃতি বহন করছে।
🔹 তিনি আমাদের সমাজ, শিক্ষা ও ভাষার নীতিগত ভিত্তি রচয়িতা

 

📌 উপসংহার:
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা সমাজ ও সাহিত্যের এক মহান দিগ্দর্শক। তাঁর আদর্শ, চিন্তাভাবনা এবং সাহিত্যকীর্তি আজও আমাদের পথ দেখায়। তিনি বাংলা ভাষার সাধনায়, সমাজ সংস্কারে ও শিক্ষাবিস্তারে যে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

 

https://www.munshiacademy.com/ঈশ্বরচন্দ্র-বিদ্যাসাগর/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *