আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Spread the love

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

🎂 জন্ম ও পরিবার

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জন্মগ্রহণ করেন ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে, গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে (মামার বাড়ি)। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল বগুড়া জেলার গ্রামে। পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন রাজনীতিক ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তার মা মরিয়ম ইলিয়াস ছিলেন একজন শিক্ষিতা গৃহিণী।

 

🎓শিক্ষা ও পেশা

তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
পেশাগত জীবনে জগন্নাথ কলেজ, সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করেন। ঢাকা কলেজে তিনি বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। কিছুদিন শিক্ষা অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

✍️ সাহিত্যকর্ম

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যের একজন অসাধারণ কথাসাহিত্যিক। তার সাহিত্যজীবন ছোটগল্প দিয়ে শুরু হলেও তিনি উপন্যাসেও নিজস্ব অবস্থান গড়ে তোলেন।

📘 উপন্যাস

  • চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬): ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনের পটভূমিতে ঢাকা শহরের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন।
  • খোয়াবনামা (১৯৯৬): এই উপন্যাসে উত্তরবঙ্গের কৃষক সমাজ, তেভাগা আন্দোলন, মুসলিম লীগের রাজনীতি, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ও বিভাজনের রাজনীতি উঠে এসেছে।

📗 ছোটগল্প

তার গল্পসংকলনগুলো হলো:

  • অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬)
  • খোঁয়ারি (১৯৮২)
  • দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫)
  • দোজখের ওম (১৯৮৯)
  • জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)

উল্লেখযোগ্য গল্প: উৎসব, প্রতিশোধ, যোগাযোগ, ফেরারী, খোঁয়ারি, অসুখ-বিসুখ, মিলির হাতে স্টেনগান, রেইনকোট, দুধভাতে উৎপাত, তারাবিবির মরদপোলা, দোজখের ওম, ফোঁড়া, কান্না, পায়ের নিচে জল প্রভৃতি।

মৃত্যুর পর প্রকাশিত গল্প: শন্তু, ঈদ, বংশধর, তারাদের চোখ, অতন্দ্র, নিঃশ্বাসে যে প্রবাদ, চিলেকোঠায় ইত্যাদি।

 

📚 প্রবন্ধ

  • সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু (১৯৯৮): মৃত্যুর পর কলকাতা থেকে প্রকাশিত একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ। এতে বাঙালি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের সাংস্কৃতিক বিভাজন, মৌলবাদ, শ্রেণি-সংগ্রাম, সাহিত্য-সমালোচনা বিষয় আলোচিত হয়েছে।

 

🧠 সাহিত্যরীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন বাস্তবতার নির্মোহ রূপকার। তার সাহিত্যে দেখা যায়—

  • শ্রেণিচেতনা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব,
  • নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের জটিলতা,
  • মুক্তিযুদ্ধ ও গণআন্দোলনের প্রভাব,
  • সংলাপ ও গদ্যে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ,
  • ব্যক্তি ও সমাজের অন্তর্জগৎ।

তিনি নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর সাহিত্যে তুলে ধরেন।

🏅 পুরস্কার ও স্বীকৃতি

  • বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১)
  • ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, চট্টগ্রাম (১৯৯১)
  • আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)
  • নজরুল পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ (১৯৯৮)
  • কবি তালিম হোসেন পুরস্কার (২০০০)
  • লেখিকা সংঘ পুরস্কার (২০০০)
  • নজরুল পদক (২০০১)
  • অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০২)
  • একুশে পদক (মরণোত্তর)

🕊️ মৃত্যু

১৯৯৬ সালের মার্চে তার ক্যানসার ধরা পড়ে। সেই বছরের ২০ মার্চ তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বগুড়ার নিজ গ্রামে সমাহিত করা হয়।

🔚 উপসংহার

মাত্র দুটি উপন্যাস ও কয়েকটি ছোটগল্প লিখে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার সাহিত্য বাস্তব, গভীর ও বুদ্ধিদীপ্ত। ব্যক্তি থেকে সমাজ, আত্মজ থেকে রাজনৈতিক—সব স্তরে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য জগৎ।

 

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *