কথাকলি প্রেম এবং: প্রেম ও নির্লিপ্ততার পাঠ

Spread the love

বই আলোচনা

কথাকলি প্রেম এবং
কথাকলি প্রেম এবং

ধরন: বই আলোচনা/ সমালোচনা

 

কথাকলি প্রেম এবং : রোমান্টিক ক্যানভাসে নির্লিপ্ত মনের অন্তর্বয়ন
মুনশি আলিম

 

 

জাতকবি মাত্রেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিসম্পন্ন। কবিদের চিন্তার রূপরেখা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এমনকি বোধও সাধারণের থেকে ভিন্ন হয়। কবিদের কাজই হলো শব্দে শব্দে মেলবন্ধন তৈরি করে শৈল্পিক ব্যঞ্জনার মিশেল ঘটানো। প্রকাশের সে ভাষা কখনো সখনো হয়ে ওঠে কঠিন থেকে কঠিনতরো; আবার কখনো বা প্রতিবেশীর ভাষার মতোই আপন, চিরপরিচিত। তবে সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বোদ্ধাপাঠকগণ সরল কাব্যভাষাকেই বেশি পছন্দ করেন। কবি তাহমিনা খান এমনই একজন কবি— যাঁর কাব্যভাষার সরলীকরণের জন্যই সব শ্রেণির পাঠকের কাছেই তিনি গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার প্রত্যাশা রাখেন।

২০২৩ সালে ‘এবং মানুষ প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হয় তাহমিনা খান-এর কথাকলি প্রেম এবং নামক কাব্যটি। এতে মোট কবিতা রয়েছে ৫৩টি। সাত ফর্মার এই কাব্যটিতে রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। সত্যিকার অর্থেই তাহমিনা খান স্বভাবজাত কবি। আর স্বভাবজাত কবিদের কাব্যভাষা মূলত সাধারণ মানুষের হৃদয়েরই ভাষা। তাঁর কাব্যভাষায় রয়েছে জীবনের অন্তর্বয়ান। রণ এবং মৌন’র প্রতীকী বয়ানে সে ভাষা পেয়েছে শাশ্বত রূপ।

কবিতাকে বলা হয়ে থাকে অনুভূতির দর্পণ। বোধ এবং উপলব্ধির নির্যাস কবিতার শব্দে শব্দে প্রোথিত হয়। কবির শৈল্পিক উপস্থাপনায়, চিত্রকল্পের বর্ণালি ব্যঞ্জনায় তা হয়ে ওঠে সত্যিকারের শিল্পভাষ্য। কবির ভাষায়—

“নদীকে হাসতে দেখেছো কখনও
আমি দেখেছি
উৎসের কাছাকাছি পাথরের বুকে
চলতে চলতে সে কী উদ্দামতা তার…”
কবিকে বুঝতে হয় কবিতা দিয়ে।

তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য ঠিক তাঁর মতোই স্বতন্ত্র। কাব্য বিশ্লেষণে কয়েকটি দিক ফুটে ওঠেছে। যেমন—রোমান্টিকতা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অনুভ‚মিক উলম্ফন, বিরহের সুতীব্র রোদন, জীবনকথন, সমকালীন বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিশেল, স্মৃতিকাতরতা, নিবেদিত অন্বয়, প্রকৃতিপাঠ, মানবিকতা, বোধ, বৈশ্বিক জটিলতাসহ নানা দিক।

কবি তাহমিনা খান-এর কবিতাগুলোর আবেদন বহতা নদীর মতোই প্রবহমান। তিনি কোনো দশকের ধার ধারেননি। নিজের মতো করেই বুনন করেছেন শব্দজাল, শব্দভার, ব্যঞ্জিত শব্দশৈলী। তিনি ভাবতে চেয়েছেন, ভাবাতেও। বলতে চেয়েছেন, বলাতেও, শুনতে চেয়েছেন, শোনাতেও। অবশ্য প্রকৃত কবি কোনো দশকে সীমাবদ্ধ নন, তিনি চিরকালের। তাকে সময়ের ফ্রেমে ফেলে ভাগ করা যায় না। কবিতায় নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, স্বর দাঁড় করাতে না পারলে কোনো কবি তাঁর চেনা সময়কে অতিক্রম করতে পারেন না। কবিকে তার নিজস্ব নির্মাণ দিয়েই চিনতে হয়, বুঝতে হয়।

এ তো অনন্য রূপের ডালি—
যেন রূপালী চাঁদই একফালি
রেখেছো নিজেরই চোখের গভীরে
নামিয়ে এনেছো জোছনা
ভোরের নরম আলোতে’ …।

তাহমিনা খান একজন সফল শিক্ষক এবং লেখক। এ পরিচয়ের বাইরে রয়েছে তাঁর বাহারি সৃষ্টিশীল সত্তা। চিন্তার ক্যানভাসে সতত জাগ্রত থাকে তাঁর সৃষ্টিশীল হৃদয়। প্রতিটি কবিতায় তিনি এমনই একটা নিজস্ব বয়ান তৈরি করেছেন যা একই সঙ্গে পাঠকেরও বয়ান হয়ে ওঠেছে। কবিতার বোধ, চিন্তার পারঙ্গমতা আর এইসব বয়ান ধরেই নির্মাণ আর বিনির্মাণ চলে কবি তাহমিনা খান-এর কবিতার প্রান্তরে। এজন্য কাব্যতীর্থে তাঁর স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ। ভাবাবেগ আর চিত্রকল্পের ভুবনে তিনি সত্যিই অন্যরকম—

আমাকে সেই কষ্ট দিয়ো না
যে কষ্ট স্পর্শ করে তোমাকেই
আমি নিজের যতটা মেনে নিই
সামান্যও কী করে যে তোমার সই!

এ যুগের অনেক কবিই নিজের কবিতাকে স্বতন্ত্রধারায় নিয়ে এলেও শব্দের কাঠিন্য থেকে মুক্তি দিতে পারেননি। আমরা জানি যে, যিনি বা যাঁরা কবিতাকে জড় ধর্ম থেকে মুক্তি দিয়ে সজীব করে তোলেন তিনি বা তাঁরাই হলো সেরা। ভাষার সরলীকরণ দিয়ে, সৃষ্টিশীলতার নৈপুণ্য উন্মোচিত করে, শব্দের দুর্বোধ্যতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে শব্দ-ব্যঞ্জনায় কবি কবি তাহমিনা খান যে পরিমিতি বোধ দেখালেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

সবার মন তো পড়া যায় না!
তার আসল নকলও
জানা হয় না
অথচ সেই হাসিময় চোখে
যেন কেবলই আটকে যাওয়া বিস্ময়ে…

শব্দই হলো অমোঘ অস্ত্র, শব্দকেই বলা হয় শব্দব্রহ্ম বা ব্রহ্মাস্ত্র! আর এই শব্দ দিয়ে কবি একের পর এক অঙ্কন করেছেন বোধের মহাবিশ্বাস। সমকালীন বাস্তবতা, জীবনের জটিলতা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গ্রন্থিমোচন, চিন্তাচেতনার ঋদ্ধতা এমনকি শুদ্ধতার স্বর অনুক্রমিকভাবেই তাঁর কাব্যশরীরের লেপটে রয়েছে।

ছায়ার মতো মায়া জড়ানো
সীমাহীন দিগন্তে আকাশের হাতছানি
বিস্তৃত গভীর অগভীর, কাছের দূরের
সবুজ অথবা ধূসর জীবন
বা জীবনবিহীন বহুরূপী উপত্যকার
নিঃশব্দেরও শতকথার চলাচলে…

কবি তাহমিনা খান-এর কথাকলি প্রেম এবং কাব্যটির সবগুলো কবিতাতেই পাঠক অমিয় রসে সিক্ত হবে, ভাবাবেগে আহ্লাদিত হবে। বিষয়-বৈচিত্র্যেও তাঁর লেখায় রয়েছে নিজস্বতা। তিনি এক অদম্য স্বপ্নচারী। তাঁর স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন কবিতার ভেতর-বাহিরে। কবিতার মাধ্যমে তিনি যেমন ঘুমপাড়াতে জানেন, তেমনই জানেন ঘুম থেকে জাগাতে। পাঠক কোনোপ্রকার অভিধান ছাড়াই কবিতার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। কাব্য বুননে তিনি তাঁর মতোই স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। উপাদান সংগ্রহে তিনি বিচরণ করেছেন সভ্যতার নগ্ন মেঠো পথে।

ভালোবাসলে মন হয়ে যায় অবুঝ
বিশ্বাসটা বুঝি নিজের ওপরই
আর থাকতে চায় না, মন বলে—
এই বুঝি কেউ বুঝলো ভুল!

একটি কাব্যের সব কবিতাই পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না; যাওয়ার কথাও নয়। কেননা, কবির মর্জি পাঠক নির্ভর নয়! আবার পাঠকমর্জিও কবি নির্ভর নয়। আর সেকারণেই সব কবিদের সব কবিতাই পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না। যাঁদের কবিতা পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, দলিত-মথিত করে—নিঃসন্দেহে তাঁরা শক্তিশালী কবি। পাঠক হৃদয়কে সহজেই স্পর্শ করে উপমার বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা। আর সেদিক থেকে কবি তাহমিনা খান নিঃসন্দেহে সিদ্ধহস্ত। তাঁর কবিতায় উপমাগুলো স্নিগ্ধ আলোর মতোই জুড়ে থাকে কাব্য শরীর হয়ে।

কবিতায় ভাষা চয়নের ক্ষেত্রেও তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে। বিশেষ করে ভাষার সরলীকরণ এই কাব্যের মাহাত্ম্যকে অনেকটাই বেগবান করেছে। যথাসম্ভব সরল বাক্যের পথ ধরেই তিনি হেঁটেছেন। এদিক বিবেচনায় নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসার দাবিদার। এই কাব্যের প্রকৃত রসদ পেতে হলে পাঠককে অবশ্যই মূলবই ধরেই এগোতে হবে। কবিতার চিত্রকল্পের বুনো বাগান ধরেই হাঁটতে হবে।

 

https://www.munshiacademy.com/কথাকলি-প্রেম-এবং-প্রেম-ও-ন/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *