🖤 কবিতার নাম: মানুষের মৃত্যু হ’লে
👤 কবি: জীবনানন্দ দাশ — নিস্তব্ধতা ও অস্তিত্বের কবি;
🌌 কাব্যগ্রন্থ: সাতটি তারার তিমির
মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।
আজকের আগে যেই জীবনের ভিড় জমেছিলো
তা’রা ম’রে গেছে;
প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে
অন্ধকারে হারায়েছে;
তবু তা’রা আজকের আলোর ভিতরে
সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে
যথন প্রেমের কথা বলে
অথবা জ্ঞানের কথা—
অনন্ত যাত্রার কথা মনে হয় সে-সময়
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের;
চলেছে— চলেছে—
একদিন বুদ্ধকে সে চেয়েছিলো ব’লে ভেবেছিলো।
একদিন ধূসর পাতায় যেই জ্ঞান থাকে— তাকে।
একদিন নগরীর ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে
বিজ্ঞানে প্রবীণ হ’য়ে— তবু— কেন অম্বাপালীকে
চেয়েছিলো প্রণয়ে নিবিড় হ’য়ে উঠে!
চেয়েছিলো—
পেয়েছিলো শ্রীমতীকে কম্প্র প্রাসাদে:
সেই সিঁড়ি ঘুরে প্রায় নীলিমার গায়ে গিয়ে লাগে;
সিঁড়ি উদ্ভাসিত ক’রে রোদ;
সিঁড়ি ধ’রে ওপরে ওঠার পথে আরেক রকম
বাতাস ও আলোকের আসা-যাওয়া স্থির ক’রে কি অসাধারণ
প্রেমের প্রয়াণ? তবু— এই শেষ অনিমেষ পথে
দেখেছে সে কোনো এক মহীয়সী আর তার শিশু;
দু-জনেই মৃত।
অথবা কেউ কি নেই!
ওইখানে কেউ নেই।
মৃত্যু আজ নারীনর্দামার ক্বাথে;
অন্তহীন শিশুফুটপাতে;
আর সেই শিশুদের জনিতার কিউক্লীবতায়।
সকল রৌদ্রের মতো ব্যাপ্ত আশা যদি
গোলকধাঁধায় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে
শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিলো?
সূর্য যদি কেবলি দিনের জন্ম দিয়ে যায়,
রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের,
মানুষ কেবলি যদি সমাজের জন্ম দেয়,
সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের,
বিপ্লব নির্মম আবেশের,
তা হ’লে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিলো?
নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আছে;
অথচ নগরী মৃত।
সে-সিঁড়ির আশ্চর্য নির্জন
দিগন্তরে এক মহীয়সী,
আর তার শিশু;
তবু কেউ নেই।
ঢের ভারতীয় কাল— পৃথিবীর আয়ু— শেষ ক’রে
জীবনের বঙ্গাব্দ পর্বের প্রান্তে ঠেকে,
পুনরুদ্যাপনের মতন আরেকবার এই
তেরোশো পঞ্চাশ সাল থেকে শুরু ক’রে ঢের দিন
আমারো হৃদয় এই সব কথা ভেবে
সৃষ্টির উৎস আর উৎসারিত মানুষকে তবু
ধন্যবাদ দিয়ে যায়।
কেননা সৃষ্টির নিহিত ছলনা ছেলে-ভুলোবার মতো তবু নয়;
মানুষও ঘুমের আগে কথা ভেবে সব সমাধান
ক’রে নিতে চায়;
কথা ভেবে হৃদয় শুকায় জেনে কাজ করে।
সময় এখনো শাদা জলের বদলে বোনভায়ের
নিয়ত বিপন্ন রক্ত রোজ
মানুষকে দিয়ে যায়;
ফসলের পরিবর্তে মানুষের শরীরে মানুষ
গোলাবাড়ি উঁচু ক’রে রেখে নিয়তির
অন্ধকারে অমানব;
তবুও গ্লানির মতো মানুষের মনের ভিতরে
এই সব জেগে থাকে ব’লে
শতকের আয়ু— আধো আয়ু— আজ ফুরিয়ে গেলেও এই শতাব্দীকে তা’রা
কঠিন নিস্পৃহভাবে আলোচন ক’রে
আশায় উজ্জ্বল রাখে; না হ’লে এ ছাড়া
কোথাও অন্য কোনো প্রীতি নেই।
মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
আরো ভালো— আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার
পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ
কতো দূর অগ্রসর হ’য়ে গেল জেনে নিতে আসে
🖋️ জীবনানন্দ দাশ – একটি বায়োগ্রাফি
👤 পুরো নাম: জীবনানন্দ দাশ
📅 জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯
📍 জন্মস্থান: বরিশাল, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
⚰️ মৃত্যু: ২২ অক্টোবর ১৯৫৪, কলকাতা, ভারত
🎓 শিক্ষাজীবন:
জীবনানন্দ দাশ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।
👨🏫 পেশা:
তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। কলকাতার বিভিন্ন কলেজে ইংরেজি পড়িয়েছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা করে গেছেন আজীবন।
📚 সাহিত্যকর্ম:
জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা কবিতায় নতুন ধারার সূচনা করেন তিনি। তাঁর কাব্যভাষা ছিল বিমূর্ত, প্রতীকধর্মী এবং গভীর দার্শনিকতায় মোড়ানো।
🔹 প্রধান কাব্যগ্রন্থ:
- ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)
- বনলতা সেন (১৯৪২)
- মহাপৃথিবী (১৯৪৪)
- সাতটি তারার তিমির
- রূপসী বাংলা (মরণোত্তর, ১৯৫৭)
🔸 গদ্য ও প্রবন্ধ:
জীবনানন্দ কবিতার পাশাপাশি গদ্য সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন। তাঁর লেখা উপন্যাস ও প্রবন্ধে পাওয়া যায় গভীর মনন ও জীবন দর্শনের প্রতিফলন।
🌌 কবিতার বৈশিষ্ট্য:
- অস্তিত্বচেতনা ও নিঃসঙ্গতা
- প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ও রূপসৌন্দর্য
- স্মৃতি, সময়, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম ভাবনা
- প্রতীকধর্মী ও বিমূর্ত কাব্যভাষা
- স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্র রূপ
📖 উল্লেখযোগ্য কবিতা:
- বোধ
- মানুষের মৃত্যু হলে
- সেদিন এ-ধরণীর
- আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
- বনলতা সেন
- রূপসী বাংলা
🚉 মৃত্যু:
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর, কলকাতার একটি রাস্তায় ট্রামের ধাক্কায় তিনি গুরুতর আহত হন। এক সপ্তাহ পর, ২২ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। এই আকস্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক নিঃশব্দ কিন্তু চিরস্থায়ী শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
🕯️ উত্তরাধিকার:
জীবনানন্দ দাশ বাংলা আধুনিক কবিতার পথিকৃত। মৃত্যুর পরে তাঁর অনেক অপ্রকাশিত কবিতা, উপন্যাস ও গদ্য প্রকাশিত হয়, যা বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করে। তিনি এক “নির্জনতম কবি” যাঁর কবিতায় নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্বজিজ্ঞাসার এক অনন্য আবহ রচিত হয়েছে।
https://www.munshiacademy.com/মানুষের-মৃত্যু-হলে-জীবন/
♠ কবি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে নিচের ভিডিয়ো দেখুন: