সমাস নির্ণয়ের সহজ উপায়
বোনাস: এখানে পাবেন অল্প সময়ে মনে রাখার সহজ টিপস!
ধরন: ব্যাকরণ
বাংলা ভাষার ব্যাকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো সমাস। এটি ভাষাকে সংক্ষিপ্ত, অর্থবহ এবং সুদৃশ্য করে তোলে। যারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিখতে আগ্রহী, তাদের জন্য সমাস বুঝে নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সমাস কী?
সমাস শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘সমা+অস’ ধাতু থেকে, যার অর্থ একত্র হওয়া বা সংক্ষেপ করা। ব্যাকরণিক দৃষ্টিতে, সমাস হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দুটি বা ততোধিক শব্দ একত্র হয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করে এবং মধ্যবর্তী অব্যয় শব্দ (যেমন—এর, ও, কে, ইত্যাদি) লোপ পায়।
> সংজ্ঞা:
যখন দুটি বা ততোধিক শব্দ একত্র হয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করে এবং মধ্যবর্তী অব্যয় বা বিভক্তি লোপ পায়, তখন তাকে সমাস বলে।
উদাহরণ:
রাম ও লক্ষ্মণ → রামলক্ষ্মণ
সোনার কাঁকন → সোনাকাঁকন
এখানে ‘ও’, ‘এর’ অব্যয়টি বাদ দিয়ে শব্দগুলো একত্রিত হয়ে নতুন অর্থবোধক শব্দ সৃষ্টি করছে — এটিই সমাস।
—
সমাসের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা
সমাসের ব্যবহার শুধু ব্যাকরণগত নয়, ভাষার রূপ, সৌন্দর্য ও গঠনকেও প্রভাবিত করে। নিচে সমাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হলো—
✅ ১. ভাষার সংক্ষিপ্ততা:
সমাস ভাষাকে সংক্ষিপ্ত করে। একাধিক শব্দের পরিবর্তে একটি সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করলে বাক্য ছোট ও সরল হয়।
উদাহরণ:
বিপদের সময় সাহায্যকারী বন্ধু → আপদসখা
✅ ২. কাব্য ও সাহিত্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি:
সমাসের মাধ্যমে শব্দকে নান্দনিক ও ছন্দময় করা যায়, যা সাহিত্যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
✅ ৩. অর্থে গভীরতা আনে:
সমাস শব্দে গভীর অর্থ থাকে, যা সাধারন বাক্যাংশ দিয়ে বোঝানো কঠিন।
সমাসের মূল উপাদান
সমাস সাধারণত দুটি উপাদান দ্বারা গঠিত:
1. পূর্বপদ (প্রথম অংশ)
2. পরপদ (দ্বিতীয় অংশ)
সমাসবদ্ধ শব্দে কোন পদটি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি গৌণ, তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকারভেদ হয়।
সমাসের প্রকারভেদ
বাংলা ভাষায় সমাস সাধারণত চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত:
১. দ্বন্দ্ব সমাস
সংজ্ঞা:
যখন সমাসবদ্ধ দুই বা ততোধিক পদের মধ্যে সমান গুরুত্ব থাকে এবং একত্রে তারা একটি গোষ্ঠী বা যৌথ পদ বোঝায়, তখন তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।
লক্ষণ:
প্রত্যেকটি পদ সমান গুরুত্ব পায়
মাঝখানে ‘ও’, ‘আর’ জাতীয় অব্যয় থাকে (সমাস বিচ্ছেদে)
উদাহরণ:
মা ও বাবা → মা–বাবা
রাম ও লক্ষ্মণ → রামলক্ষ্মণ
গঙ্গা ও যমুনা → গঙ্গাযমুনা
সমাস বিচ্ছেদ:
রামলক্ষ্মণ → রাম ও লক্ষ্মণ
২. দ্বিগু সমাস
সংজ্ঞা:
যে সমাসে পূর্বপদ সংখ্যা বা বিশেষণ হয় এবং পরপদ বিশেষ্য পদ হয়, এবং পরপদটিই প্রধান, তাকে দ্বিগু সমাস বলে।
লক্ষণ:
সংখ্যা বা পরিমাণ বোঝানো হয়
পরপদ প্রধান হয়
উদাহরণ:
দুই জন ভাই → দুইভাই
তিনটি মেয়ে → তিনমেয়ে
সাতটি রথ → সপ্তরথ (সংস্কৃত)
সমাস বিচ্ছেদ:
দুইভাই → দুই জন ভাই
—
৩. তৎপুরুষ সমাস
সংজ্ঞা:
যে সমাসে পূর্বপদ গৌণ এবং পরপদ প্রধান হয়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে।
লক্ষণ:
সাধারণত পূর্বপদ বিশেষণ হিসেবে কাজ করে
পরপদ অর্থবোধক পদ হিসেবে প্রধান হয়
তৎপুরুষ সমাসের উপবিভাগ:
তৎপুরুষ সমাসের মোট ৬টি প্রধান উপবিভাগ রয়েছে —
১ম থেকে ৬ষ্ঠ বিভক্তির উপর ভিত্তি করে।
উদাহরণ:
রাজ + পুত্র → রাজপুত্র (রাজের পুত্র) → ষষ্ঠীতৎপুরুষ
জল + কুম্ভ → জলকুম্ভ (জলের কুম্ভ)
ধন + জন → ধনজন (ধনের জন্য জন) → চতুর্থীতৎপুরুষ
সমাস বিচ্ছেদ:
রাজপুত্র → রাজের পুত্র
৪. বহুব্রীহি সমাস
সংজ্ঞা:
যে সমাসে কোন পদই মূল অর্থ বোঝায় না, বরং অন্য কোন বস্তুকে নির্দেশ করে, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।
লক্ষণ:
মূল দুই পদ নয়, কোন তৃতীয় বিষয় বোঝানো হয়
এটি একটি বিশেষণ বা বিশেষ্য হয়
উদাহরণ:
পীত + অম্বর → পীতাম্বর (যার অম্বর পীত) → কৃষ্ণ
চন্দ্র + মুখ → চন্দ্রমুখী (যার মুখ চাঁদের মতো)
সমাস বিচ্ছেদ:
পীতাম্বর → যে অম্বর পরিধান করে সে পীত (কৃষ্ণ)
—
অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমাস (আধুনিক প্রয়োগ)
কর্মধারয় সমাস: বিশেষ্য + বিশেষণ বা সমার্থক পদের সমাস
যেমন: মহামানব, কালপুরুষ
অব্যয়ীভাব সমাস: অব্যয় পদ + বিশেষ্য পদ → অব্যয় হয়
যেমন: দিনে দিনে, মুখে মুখে
সমাস বিচ্ছেদ ও তার নিয়ম
সমাসবদ্ধ পদকে পৃথক করে মূল শব্দগুলো বের করাকে সমাস বিচ্ছেদ বলে। সমাস বুঝতে হলে তার বিচ্ছেদ কৌশল জানা প্রয়োজন।
কীভাবে করব?
1. সমাসবদ্ধ শব্দকে দেখে ধরুন এটি কোন প্রকারের
2. মূল শব্দে রূপান্তর করুন
3. বিভক্তি বা অব্যয় যুক্ত করুন
উদাহরণ:
রাজপুত্র → রাজের পুত্র
রামলক্ষ্মণ → রাম ও লক্ষ্মণ
তিনভাই → তিন জন ভাই
পীতাম্বর → যে অম্বর পীত (অর্থ: কৃষ্ণ)
কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমাস উদাহরণ তালিকা
শিক্ষার্থীদের জন্য সমাস শেখার টিপস
1. প্রথমে বিচ্ছেদ করুন:
শব্দ ভেঙে দেখুন কী কী পদ আছে।
2. অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন:
সমাস বুঝতে হলে সম্পূর্ণ শব্দের অর্থ বোঝা জরুরি।
3. প্রত্যেক সমাসের লক্ষণ মুখস্থ রাখুন:
লক্ষণ জানলে ধরতে সহজ হয়।
4. সারণি বা চার্ট তৈরি করুন:
চোখের সামনে রাখলে বারবার দেখে মনে রাখা সহজ হয়।
5. অভ্যাস করুন:
প্রতিদিন কয়েকটি সমাস বিশ্লেষণ করুন।
উপসংহার
সমাস বাংলা ভাষার ব্যাকরণে একটি মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়। ভাষাকে সংক্ষিপ্ত, সুন্দর ও অর্থবহ করার জন্য সমাসের জুড়ি নেই। সাহিত্য, কবিতা কিংবা সাধারণ ভাষায় সমাসের ব্যবহার শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত অনুশীলন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাস আয়ত্ত করা খুবই সহজ।
বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার উপযোগী ৬০টি গুরুত্বপূর্ণ সমাস। প্রয়োজনে শেয়ার করে রাখুন।
🔵 তৎপুরুষ সমাস (Tatpurush Samas)
➡ একটি শব্দ অপর একটি শব্দের ওপর নির্ভরশীল হয়। সাধারণত উত্তরপদ প্রধান হয়।
ক্র. | শব্দ | বিশ্লেষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|---|
1 | রাজপুত্র | রাজার পুত্র | “পুত্র” প্রধান, “রাজ” তার যোগ্যতা |
2 | রথযাত্রা | রথের যাত্রা | যাত্রা হচ্ছে মূল বিষয়, রথ সহায়ক |
3 | কৃষ্ণজল | কৃষ্ণ বর্ণের জল | জলের রং বোঝাতে কৃষ্ণ উপপদ |
4 | গৃহদ্বার | গৃহের দ্বার | দ্বার বা দরজা মূল, গৃহ সহায়ক |
5 | জলপান | জলের পান | পান করাটাই মুখ্য |
6 | বনভোজন | বনের ভোজন | ভোজন গুরুত্বপূর্ণ, বন স্থানবিশেষ |
7 | কর্মক্ষেত্র | কর্মের ক্ষেত্র | ক্ষেত্র হলো যেখানে কর্ম হয় |
8 | ভগবত্কৃপা | ভগবানের কৃপা | কৃপা মুখ্য, ভগবান সূত্র |
9 | বিশ্ববন্ধু | বিশ্বের বন্ধু | বন্ধু মুখ্য, বিশ্ব সহায়ক |
10 | রাজভিখারি | রাজার মতো ভিখারি | ভিখারি মুখ্য, রাজা উপমা |
🟢 কর্মধারয় সমাস (Karmadharaya Samas)
➡ সমাসের পূর্বপদ ও উত্তরপদ সমান মর্যাদাসম্পন্ন হয়। বিশেষ্য-বিশেষণ বা উপমাসূচক অর্থ গঠিত হয়।
ক্র. | শব্দ | বিশ্লেষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|---|
11 | নীলকমল | নীল যে কমল | রঙের বৈশিষ্ট্যসহ নাম |
12 | মহামানব | মহান যে মানব | মানব প্রধান, বিশেষ্য-বিশেষণ |
13 | রক্তরঙ | রক্তের মতো রঙ | উপমাসূচক |
14 | শুভসকাল | শুভ যে সকাল | সকালকে শুভ বলা হচ্ছে |
15 | সুন্দরবন | সুন্দর যে বন | বনকেই সুন্দর বলা হয়েছে |
16 | দীর্ঘশ্বাস | দীর্ঘ যে শ্বাস | দীর্ঘ শ্বাস বোঝায় |
17 | কপোতপর্ণি | কপোতের মতো পাখা | উপমা-ভিত্তিক |
18 | চন্দ্রবদন | চাঁদের মতো মুখ | মুখ উপমিত হচ্ছে চন্দ্র দিয়ে |
19 | সুশিক্ষা | ভালো শিক্ষা | বিশেষ্য-বিশেষণ |
20 | চিরসবুজ | চিরকাল সবুজ | বিশেষণধর্মী |
🟣 দ্বন্দ্ব সমাস (Dvandva Samas)
➡ দুটি বা ততোধিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, সবগুলো পদই গুরুত্বপূর্ণ।
ক্র. | শব্দ | বিশ্লেষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|---|
21 | মা-বাবা | মা ও বাবা | উভয় সমান গুরুত্ব |
22 | রাম-শ্যাম | রাম এবং শ্যাম | দুইজন ব্যক্তির যৌথ রূপ |
23 | দিন-রাত | দিন ও রাত | সময়ের দুই অংশ |
24 | সুখ-দুঃখ | সুখ ও দুঃখ | জীবনচক্র বোঝাতে |
25 | শীত-গ্রীষ্ম | শীত ও গ্রীষ্ম | ঋতুর মিলন |
26 | চোখ-কান | চোখ ও কান | দুটি ইন্দ্রিয় |
27 | আগুন-পানি | আগুন ও পানি | বিপরীতধর্মী বস্তু |
28 | ছেলে-মেয়ে | ছেলে ও মেয়ে | লিঙ্গভেদ বোঝায় |
29 | সাদা-কালো | দুই ধরনের রঙ | |
30 | তরকারি-ভাত | দুটি খাদ্য পদ |
🔶 বহুব্রীহি সমাস (Bahuvrihi Samas)
➡ সমাসবদ্ধ শব্দ দিয়ে গঠিত হয় তৃতীয় কোনো ব্যক্তির বা বস্তুর অর্থ। অর্থ অন্য কোথাও প্রযোজ্য হয়।
ক্র. | শব্দ | বিশ্লেষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|---|
31 | নীলকণ্ঠ | যার কণ্ঠ নীল | শিবের নাম, নিজে নীল নয় |
32 | ত্রিনয়ন | যার তিনটি নয়ন | শিবের বৈশিষ্ট্য |
33 | চক্রপাণি | যার হাতে চক্র | বিষ্ণুর বর্ণনা |
34 | চতুরানন | যার চার মুখ | ব্রহ্মার বৈশিষ্ট্য |
35 | পদ্মনয়ন | পদ্মের মতো নয়ন যার | |
36 | চন্দ্রানন | চাঁদের মতো মুখ | |
37 | রাজর্ষি | রাজা হলেও ঋষিসদৃশ | |
38 | অগ্নিস্বভাব | যার স্বভাব আগুনের মতো | |
39 | মধুবর্ণ | যার বর্ণ মধুর মতো | |
40 | নীলদন্ত | যার দাঁত নীল রঙের |
🟡 দ্বিগু সমাস (Dvigu Samas)
➡ সংখ্যাবাচক বা পরিমাপবাচক শব্দের সঙ্গে বিশেষ্য বা বিশেষণের যোগে গঠিত হয়।
ক্র. | শব্দ | বিশ্লেষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|---|
41 | পঞ্চপাণ্ডব | পাঁচজন পাণ্ডব | সংখ্যা সহ গঠিত |
42 | একচল্লিশ | এক ও চল্লিশ | যৌগিক সংখ্যা |
43 | শতপত্র | একশো পত্রবিশিষ্ট | পদ্ম ইত্যাদির বর্ণনা |
44 | দশভুজ | দশটি ভুজা আছে যার | দুর্গার বর্ণনা |
45 | ত্রিমূর্তি | তিনটি মূর্তি | ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব |
46 | চতুর্বেদ | চারটি বেদ | |
47 | ষোড়শী | ষোলো বছর বয়সী তরুণী | |
48 | দ্বিপদ | দুই পা আছে যার | |
49 | শতদল | শত পাপড়ি বিশিষ্ট | |
50 | নবগ্রহ | নয়টি গ্রহ |
🔴 অব্যয়ীভাব সমাস (Avyayibhava Samas)
➡ অব্যয় পদ + নাম/ক্রিয়া পদ, সম্পূর্ণ অব্যয়ের মতো ব্যবহৃত হয়।
ক্র. | শব্দ | বিশ্লেষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|---|
51 | দিনে দিনে | দিনে দিনে বৃদ্ধি | অব্যয় পদ |
52 | মনে মনে | অন্তরে অন্তরে | অনুভবমূলক |
53 | ধাপে ধাপে | এক এক ধাপে | প্রক্রিয়াগত |
54 | গোপনে গোপনে | গোপনভাবে | |
55 | চরণে চরণে | প্রতিটি চরণে | |
56 | মুখে মুখে | সবাই বলছে এমন | |
57 | হাতে হাতে | প্রত্যেকের হাতে | |
58 | পায়ে পায়ে | প্রতি পদক্ষেপে | |
59 | বারংবার | বারবার | |
60 | উপরে উপরে | কেবল উপরের দিকে |
*** বিস্তারিত জানতে ও বুঝতে হলে নিচের ভিডিয়োটি দেখতে পারেন।