চর্যাপদ : ভাষা, ভাব, কাব্যরীতি, সমাজ–সংস্কৃতি ও সাহিত্য–ইতিহাসে অবস্থান

চর্যাপদ : ভাষা, ভাব, কাব্যরীতি, সমাজ–সংস্কৃতি ও সাহিত্য–ইতিহাসে অবস্থান


চর্যাপদ : ভাষা, ভাব, কাব্যরীতি, সমাজ–সংস্কৃতি ও সাহিত্য–ইতিহাসে অবস্থান


ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম ধাপকে বুঝতে হলে চর্যাপদ নিয়ে আলোচনা অপরিহার্য। বাংলা ভাষার অতি প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদ কেবল সাহিত্যিক দলিলই নয়, বরং ধর্ম–দর্শন, সমাজ–সংস্কৃতি, ভাষাবিজ্ঞান এবং মানবজীবনের গভীর অভিজ্ঞতার এক অনন্য ভাণ্ডার। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত এই গীতিকবিতাগুলো সিদ্ধাচার্যদের আধ্যাত্মিক সাধনার বহিঃপ্রকাশ। গুপ্ত ভাষা বা ‘সন্ধ্যাভাষা’ ব্যবহার করে তন্ত্রসাধনার বোধকে কাব্যরূপ দেওয়া হয়েছিল; ফলে চর্যাপদ একই সঙ্গে কাব্য, দর্শন ও জীবনবোধের সম্মিলিত একটি দলিল। অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের সংগ্রহ থেকে এই পুঁথি আবিষ্কার করে বাংলাভাষা–সাহিত্যকে নতুন আলোকময়তায় পৌঁছে দেন।

এই প্রবন্ধে চর্যাপদের ভাষা, ভাব, কাব্যরীতি, প্রতীক, সমাজ–সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও গবেষণা–সংক্রান্ত নানা দিক বিশ্লেষণ করা হবে।


প্রথম অধ্যায় : চর্যাপদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য

চর্যাপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘বাংলা ভাষার প্রাচীনতম দলিল’ হিসেবেই চিহ্নিত করেন। চর্যাপদের ভাষা নানা উৎসের মিলিত রূপ—সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ এবং প্রাচীন আঞ্চলিক বঙ্গীয় উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।

১.1 বাংলা ভাষার উৎপত্তিতে চর্যাপদের ভূমিকা

চর্যাপদের ভাষায় বাংলা ভাষার ধ্বনিগত, রূপগত ও শব্দবিন্যাসগত বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট উপস্থিতি দেখা যায়। যেমন—

  • ‘চরি’ → ‘চরি-এ’, ‘চরিয়া’—বাংলার ক্রিয়া-কারকের প্রথম রূপ
  • ‘গরু’, ‘ঘর’, ‘নর’, ‘মোর’—আজকের বাংলা শব্দের আদিরূপ
  • ‘করই’, ‘যাই’, ‘পাছে’, ‘কেম’—বাংলা ধ্বনির আদি অবস্থান
    এর ফলে ভাষার বিবর্তন ধারা অনুসন্ধানে চর্যাপদ একটি মূল ভিত্তি।

১.2 ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য

  • স্বরবর্ণের হ্রস্ব–দীর্ঘ ব্যবহার
  • অনুস্বারের প্রচুর ব্যবহার
  • দন্ত্য ও মূর্ধন্য ধ্বনির মিশ্র রূপ
    এই ধ্বনি-রীতিতে বাংলা ভাষার নিজস্বতা প্রকাশ পেতে শুরু করে।

১.3 রূপগত বৈশিষ্ট্য

ক্রিয়া-রূপ যেমন—

  • “করইল”, “যাইল”, “ভুজিল” → অপভ্রংশের ধারা
  • “যাই”, “খাই”, “পাছে” → বাংলা রূপের সূচনা
    বিশেষণ ও সর্বনামেও বাংলা রূপের প্রাথমিক চিহ্ন পাওয়া যায়।

১.4 সন্ধ্যাভাষা

চর্যাপদের ভাষার বৈশিষ্ট্য বোঝার ক্ষেত্রে ‘সন্ধ্যাভাষা’ অনিবার্য বিষয়। এটি যথেচ্ছ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি; বরং তন্ত্রসাধনার রহস্য লুকানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বহু প্রতীক ও গুপ্ত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন—

  • নৌকা = দেহ
  • নদী = সংসার
  • মাঝি = গুরু
  • মীন = মন
    এই কারণে চর্যাপদের ভাষা একই সঙ্গে লৌকিক ও গুপ্ত, সরল ও জটিল।

দ্বিতীয় অধ্যায় : কাব্যরীতি ও শিল্পরূপ

চর্যাপদ শুধু ভাষার নয়, কাব্য-ঐতিহ্যেরও সূচনার নির্দেশ করে। এর কাব্যরীতি, ছন্দ, সংগীতবোধ, প্রতীকী ব্যঞ্জনা বাংলা কাব্যের প্রথম ভিত্তি নির্মাণ করেছে।

২.১ কাব্যরীতি

চর্যাগুলো গীতিকবিতা—গাওয়া হতো নির্দিষ্ট রাগ-রাগিণীতে। আবেগ, বেদনা, আধ্যাত্মিকতা—সব মিলিয়ে এক অনন্য সংগীত-ধর্মী কাব্যরূপ সৃষ্টি হয়েছে। ছন্দরীতির মধ্যে ‘দো-হা’ ধারা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

২.২ প্রতীক ও রূপক

চর্যাপদের শিল্পরূপের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক প্রতীক।

  • নৌকা—জীবন
  • সমুদ্র/নদী—সংসার
  • গুরু-মাঝি—মোক্ষপথের চালক
  • মাছ—মন
  • পাখি—আত্মা
    এ প্রতীকগুলো কখনো লৌকিক, কখনো আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে।

২.৩ অলংকার

উপমা, রূপক, মানবিকরণ, পুনরুক্তি প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার কাব্যকে শক্তিশালী করেছে।
যেমন—
“মনের মীন যায় এদিকে সেদিকে”—এটি প্রকৃতপক্ষে মনোবৃত্তির চঞ্চলতা।

২.৪ চর্যাপদের কবিত্বগুণ

লৌকিক জীবন, প্রকৃতি, মানুষের দুঃখ, জীবনের ধারা—সবকিছু কাব্যে রূপ পেয়েছে। স্বল্প শব্দে তীব্র আবেগ প্রকাশ করা হচ্ছে চর্যাগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।


তৃতীয় অধ্যায় : সমাজ–সংস্কৃতি ও ধর্ম–দর্শনের প্রতিফলন

চর্যাপদ তন্ত্রসাধনার এক বিশেষ ধারার কবিতা হলেও এর মধ্যে প্রাচীন বাংলার সমাজ–সংস্কৃতি জীবন্ত।

৩.১ সমাজবাস্তবতা

চর্যায় কৃষিজীবী সমাজ, নদী–নৌকার জীবন, গ্রামীণ মানুষের দুঃখ–কষ্ট, নারী–পুরুষের সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবনের রূপক-ছবি পাওয়া যায়।
যেমন—

  • নদী, নৌকা, মাঝি → বঙ্গের নদীমাতৃক বৈশিষ্ট্য
  • চাষাবাদ, চাল, তেল, গৃহস্থালি শব্দ → গ্রামীণ বাস্তবতা
    চর্যা আধ্যাত্মিক হলেও এ জগত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

৩.2 ধর্ম–দর্শন

চর্যাগুলো মহাযোগ, তন্ত্রসাধনা ও বৌদ্ধ সাহজযানের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
এখানে মুক্তি মানে—

  • চিত্তশুদ্ধি
  • অহং বিলোপ
  • অন্তর্দর্শন
    সাধক ‘শূন্য’-এর অন্বেষণে নিমগ্ন—যা মহাযানের ‘শূন্যবাদ’-এর প্রতিফলন।

৩.৩ নারী–পুরুষ প্রতীক

নারী প্রতীক সাধনার শক্তির প্রতীক; পুরুষ প্রতীক জ্ঞান বা শিবতত্ত্বের প্রতীক। এই যোগসংযোগ নিয়ে বহু চর্যা লেখা হয়েছে, যা বাহ্যিকভাবে প্রেম, কিন্তু অন্তর্নিহিতভাবে সাধনার চিত্র।


চতুর্থ অধ্যায় : রচয়িতা ও তাঁদের সাধনপদ্ধতি

চর্যাপদের রচয়িতারা ‘সিদ্ধাচার্য’ নামে পরিচিত। তারা প্রধানত বৌদ্ধ সাহজয়ান বা তান্ত্রিক সাধক।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধাচার্য—

  • লুইপা
  • শবরপা
  • কুক্কুরিপা
  • কাহ্নাপা
  • ভুসুকুপা
  • দরিয়া নাথ
  • তান্ত্রিক হাড়িবংশ

৪.১ সাধনপদ্ধতি

তাঁদের সাধনা ছিল—

  • বৈরাগ্য
  • দেহ–মন পরিষ্কার
  • অন্তর্দর্শন
  • গুরু–শিষ্য সম্পর্ক
  • প্রতীকের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি
    এ কারণে চর্যাপদের বেশির ভাগ কবিতা ‘দেহতত্ত্ব’ ও ‘চক্রতত্ত্ব’-এর সংকেতবাহী।

পঞ্চম অধ্যায় : চর্যাপদের আবিষ্কার ও গবেষণার গুরুত্ব

৫.১ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অবদান

১৯০৭ সালে তিনি নেপালের রাজদরবারের সংগ্রহ থেকে ‘চর্যাগীতি’ পুঁথি আবিষ্কার করেন।
বাংলা সাহিত্য–ইতিহাসের ক্ষেত্রে এ আবিষ্কার—

  • প্রমাণ করল যে বাংলা ভাষার লিখিত নিদর্শন খুবই প্রাচীন।
  • বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য পুনরায় আলোচনায় আসে।
  • বাংলা ভাষা–সাহিত্যের উৎসতত্ত্ব নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়।

৫.২ গবেষণা–সংক্রান্ত সমস্যাবলি

  • পুঁথির বেশ কিছু অংশ নষ্ট
  • প্রতীকের অর্থ নির্ণয়ে মতপার্থক্য
  • ভাষা-পরিবর্তনের ধারা অসম্পূর্ণ
    তবু গবেষকদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় চর্যাপদ আজ সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পেয়েছে।

ষষ্ঠ অধ্যায় : চর্যাপদ ও বাংলা সাহিত্য–ইতিহাস

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে এক সেতুবন্ধন—সংস্কৃত/পালি সাহিত্য ঐতিহ্য থেকে বাংলা পদাবলি, বৈষ্ণব কবিতা, মধ্যযুগের কাব্যধারা—সব কিছুর মধ্যবর্তী একটি ধাপ।

৬.১ বৈষ্ণব পদাবলির পূর্বভূমিকা

  • রাধা–কৃষ্ণ ভাব ও প্রেম প্রতীকের আধ্যাত্মিক দিক চর্যায়ই সূচনা পেয়েছে।
  • গানের ধারা পরবর্তীতে পদাবলীতে পরিণত হয়।

৬.২ বাংলা কাব্যের ভিত্তি স্থাপন

  • প্রতীকের ব্যঞ্জনা
  • গীতিকবিতার ধারা
  • সংগীত–কাব্য রীতি
    এসব চর্যাপদ থেকেই উদ্ভব।

৬.৩ সাহিত্যমান মূল্যায়ন

যদিও চর্যাপদের উদ্দেশ্য ছিল সাধনা, কিন্তু তার কাব্যমাধুর্য, প্রতীকী শক্তি, সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ণ ভাষা—এসবই একে উচ্চমানের কাব্যে পরিণত করেছে।


চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক অনন্য মাইলফলক। ভাষাগত দিক থেকে এটি বাংলা ভাষার জন্মচিহ্ন ধারণ করে; সাহিত্যিক দিক থেকে এটি কাব্যের প্রথম ভিত্তি; সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটি বাংলার প্রাচীন কৃষি, জেলেজীবী, নদীমাতৃক জীবনযাত্রার আভাস দেয়; ধর্মীয় দিক থেকে এটি বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনার আধ্যাত্মিকতা ধারণ করে। চর্যাপদের আবিষ্কার প্রমাণ করে—বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বহু শতাব্দী পূর্বেই পরিপক্বতার পথে যাত্রা শুরু করেছিল।

বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে চর্যাপদ তাই কেবল প্রাচীনতম কাব্য নয়—এটি বাংলার আদি জনগোষ্ঠীর জীবন, মনন, চিন্তা, সাধনা ও শিল্পবোধের এক অমূল্য দলিল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *