রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: জীবন, সাহিত্য ও কর্ম
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার ও সাহিত্যিক। তিনি বিশেষভাবে বাংলাদেশের প্রতীকী ও প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত। তাঁর জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম হলো “বাতাসে লাশের গন্ধ”। বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মোংলার মিঠাখালীতে তাঁর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “রুদ্র স্মৃতি সংসদ”।
জন্ম ও শৈশব
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জের রেডক্রস হাসপাতালে। পিতার নাম ড. শেখ ওয়ালিউল্লাহ (১৯৩০-১৯৯৬) এবং মাতার নাম শিরিয়া বেগম (১৯৩৯–২০০৪)। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার সাহেবের মেঠ গ্রামে। তিনি দশটি ভাইবোনের মধ্যে বড়। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়, নিজের বোনের ট্রাংক থেকে টাকা ধার করে তিনি ও তার মামাতো ভাই মিলে একটি লাইব্রেরি তৈরি করেন, যার নাম রাখেন “বনফুল লাইব্রেরি”। এছাড়া তিনি ছোটবেলায় কিছুটা অভিমানী ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্কুলের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করার পরও, পিতার দেয়া বইগুলো তিনি ফিরিয়ে দিতেন।
যৌবন ও চরিত্র
যৌবনে রুদ্র প্রাণবন্ত, উচ্ছন্ন এবং আড্ডাপ্রিয় ছিলেন। চুল ছিল কোঁকরা এবং প্রায়ই জিন্স পরতেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী। কবি শামসুল হক উল্লেখ করেছেন, “তার মধ্যে যে অস্থিরতা ছিল তা তাকে স্থির হতে দিত না।”
শিক্ষাজীবন
রুদ্র সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করেন। তিনি ছাত্রজীবনে মেধাবী ছিলেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮০ সালে সম্মানসহ বিএ এবং ১৯৮৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
সাহিত্য ও কর্মজীবন
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালের পর নানা সরকারবিরোধী এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন, দেশাত্মবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ, গল্প, নাট্যকাব্য এবং অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গান “ভালো আছি ভালো থেকো” পরবর্তীতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি কর্তৃক ১৯৯৭ সালে মরনোত্তর শ্রেষ্ঠ গীতিকারের সম্মাননা পেয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘটনা
- ১৯৬২-৭১: শৈশব ও কিশোর বয়সে শিক্ষাজীবন, লাইব্রেরি গঠন, ক্রিকেট দল গঠন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নবম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতার প্রতি আগ্রহ।
- ১৯৭২-৭৯: ঢাকায় এসে কবিতা, গান ও নাটক রচনা। প্রথম প্রকাশিত কবিতা: “আমি ঈশ্বর আমি শয়তান” (১৯৭২)। প্রথম কাব্যগ্রন্থ “উপদ্রুত উপকূল” প্রকাশ (১৯৭৯)।
- ১৯৮০-৮৯: যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক ভূমিকা, ‘দ্রাবিড়’ প্রকাশনা গঠন, কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা, নাট্যকাব্য ও গল্প রচনা। এই সময়েই বিখ্যাত গান ও সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত।
- ১৯৯০-৯১: সপ্তম কাব্যগ্রন্থ “মৌলিক মুখোশ” প্রকাশ। গল্প, নাট্যকাব্য ও চলচ্চিত্র কাহিনী রচনা।
ব্যক্তিগত জীবন
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে ১৯৮৬ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এই সময়ের পর তিনি আরও স্বাধীন ও মুক্ত জীবন যাপন শুরু করেন।
মৃত্যু
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে নিজের বাসায় হঠাৎ হৃদরোগে (Sudden Cardiac Arrest) মারা যান। তিনি বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার মিঠাখালিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কাব্যগ্রন্থ:
- উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)
- ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম (১৯৮১)
- মানুষের মানচিত্র (১৯৮৬)
- ছোবল (১৯৮৬)
- গল্প (১৯৮৭)
- দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮)
- মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)
- খুঁটিনাটি খুনশুটি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯১)
- এক গ্লাস অন্ধকার (১৯৯২)
ছোটগল্প:
- সোনালি শিশির
নাট্যকাব্য:
- বিষ বিরিক্ষের বীজ
বড়গল্প:
- মনুষ্য জীবন
পুরস্কার ও সম্মাননা
- মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০, ১৯৮১)
- একুশে পদক (২০২৪, মরণোত্তর)
