তসলিমা নাসরিন : জীবন, সাহিত্য ও অবদান

তসলিমা নাসরিন : জীবন, সাহিত্য ও অবদান


তসলিমা নাসরিন : জীবন, সাহিত্য ও অবদান

(জন্ম: ২৫ আগস্ট ১৯৬২)

তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশী-সুইডিশ লেখক, চিকিৎসক, নারীবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও সমাজকর্মী। তিনি নারী নিপীড়ন, ধর্মবিরোধী চিন্তাভাবনা এবং ইসলামের সমালোচনা নিয়ে লেখার জন্য পরিচিত। তাঁর কিছু গ্রন্থ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এবং তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উভয় স্থান থেকে নির্বাসিত হয়েছেন।

প্রথম জীবন

তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের ২৫ আগস্ট ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। পিতা রজব আলী চিকিৎসক ও মাতা ঈদুল ওয়ারা গৃহিণী। ১৯৭৬ সালে ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি গ্রামীণ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন।

সাহিত্য জীবন

তেরো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সালে কলেজে সেঁজুতি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম কবিতা সংকলন শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতে নারী অধিকার, লিঙ্গসমতা ও সমাজকেন্দ্রিক বিষয় সমালোচনা উঠে।

১৯৯০ সালে নির্বাচিত কলাম প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে নারী অধিকার ও ইসলামী সমাজের সমালোচনা শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে লজ্জা উপন্যাস প্রকাশিত হয়, যা প্রকাশের পর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় এবং ইসলামপন্থীদের হুমকির মুখে পড়েন।

তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো:

  • কাব্যগ্রন্থ: শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা (১৯৮১), নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে (১৯৮৯), আমার কিছু যায় আসে না (১৯৯০), বালিকার গোল্লাছুট (১৯৯২), আয় কষ্ট ঝেঁপে, জীবন দেবো মেপে (১৯৯৪) ইত্যাদি।
  • প্রবন্ধসংকলন: নির্বাচিত কলাম (১৯৯০), যাবো না কেন? যাব (১৯৯১), নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প (১৯৯২), নারীর কোন দেশ নেই (২০০৭) ইত্যাদি।
  • উপন্যাস: অপরপক্ষ (১৯৯২), শোধ (১৯৯২), নিমন্ত্রণ (১৯৯৩), ফেরা (১৯৯৩), লজ্জা (১৯৯৩), ভ্রমর কইও গিয়া (১৯৯৪), ফরাসি প্রেমিক (২০০২), শরম (২০০৯) ইত্যাদি।
  • আত্মজীবনী: আমার মেয়েবেলা (১৯৯৯), উতাল হাওয়া (২০০২), ক (২০০৩), সেই সব অন্ধকার (২০০৪), আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ (২০০৬), নেই, কিছু নেই (২০১০), নির্বাসন (২০১২)।

দেশত্যাগ ও নির্বাসিত জীবন

১৯৯৪ সালে ইসলামবিরোধী মন্তব্যের কারণে বাংলাদেশে তার ওপর হত্যার হুমকি ও ফতোয়া জারি হয়। তাই তিনি দেশের বাইরে নির্বাসিত হন। প্রথমে সুইডেন, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে বসবাস করেন। ২০০০ সালে ভারতে আসেন। তবে ২০০৮ সালে ভারতেও অজ্ঞাতবাসে থাকেন এবং পরবর্তীতে দিল্লিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

বৈবাহিক জীবন

তসলিমা নাসরিনের তিনটি বিয়ে হয়েছে—রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮২, বিচ্ছেদ ১৯৮৬), নাঈমুল ইসলাম খান (১৯৯০, বিচ্ছেদ ১৯৯১), মিনার মাহমুদ (১৯৯১, বিচ্ছেদ ১৯৯২)। তার কোনো সন্তান নেই।

সমালোচনা ও বিতর্ক

তসলিমার লেখনীর কারণে বিভিন্ন সময় সমালোচনা ও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। ২০১৯ সালে তিনি বোরকা নিষিদ্ধকরণের সমর্থন করেন, ২০২১ সালে ইংরেজ ক্রিকেটার মঈন আলীকে নিয়ে বিতর্কিত টুইট করেন।

চলচ্চিত্র

তার জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্বাসিত ২০১৪ সালে মুক্তি পায় এবং ২০১৫ সালে ৬২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

  • আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২, ২০০০)
  • নাট্যসভা পুরস্কার, বাংলাদেশ (১৯৯২)
  • ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট শাখারভ পুরস্কার (১৯৯৪)
  • ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার (১৯৯৪)
  • সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল পেন কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার (১৯৯৪)
  • যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ হেলম্যান-হ্যামেট গ্রান্ট (১৯৯৪)
  • নরওয়েভিত্তিক মানবতাবাদী পুরস্কার (১৯৯৪)


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *