প্রমথ চৌধুরী : জীবন, সাহিত্য ও অবদান

প্রমথ চৌধুরী : জীবন, সাহিত্য ও অবদান


প্রমথ চৌধুরী : জীবন, সাহিত্য ও অবদান

(জন্ম: ৭ আগস্ট ১৮৬৮ — মৃত্যু: ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)

প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, কবি ও সম্পাদক হিসেবে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসেবে তিনি আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেন। পাশাপাশি বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ, সনেট রচনা এবং সাহিত্যপত্র সম্পাদনায়ও তিনি ছিলেন অগ্রদূত। সাহিত্যজগতে তিনি ‘বীরবল’ ছদ্মনামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন।

জন্ম ও পৈতৃক পরিচয়

১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে। তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত এই ভিটা আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শিক্ষাজীবন ও কৃতিত্ব

প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার হেয়ার স্কুলে। পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফএ এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে দর্শনে বিএ অনার্স সম্পন্ন করেন। ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ-তে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাতে গিয়ে বার-অ্যাট-ল’ সম্পন্ন করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী পদক’-এ সম্মানিত করে।

কর্মজীবন ও সাহিত্যচর্চা

দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করলেও পরে পেশা পরিবর্তন করে অধ্যাপনা ও সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং ঠাকুর এস্টেটের ব্যবস্থাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৮৯৩ সালে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘জয়দেব’ ছিল তার সাহিত্যজীবনের সূচনা। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের সদস্য—ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যক্তিজীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।

চলিত ভাষার প্রবর্তন

বাংলা গদ্যে চলিত রীতির সূচনা প্রমথ চৌধুরীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তিনি সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা প্রবন্ধ ও গল্পে কথ্য ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে বাংলা গদ্য আধুনিকতা লাভ করে এবং পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে অধিক সহজগ্রাহ্য।

সম্পাদনা কার্য

তিনি দীর্ঘদিন সবুজপত্র সম্পাদনা করেন এবং পরে বিশ্বভারতী পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সম্পাদনা-দর্শন বাংলা সাহিত্যে নতুন সাহিত্যধারা ও ভাষারীতি গঠনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

রচনাশৈলী ও বৈশিষ্ট্য

  • বিদ্রূপাত্মক ও ব্যঙ্গরসাত্মক লেখায় তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
  • প্রমথের গদ্য ছিল সহজ, প্রাঞ্জল, বুদ্ধিদীপ্ত ও আধুনিক।
  • তিনি বাংলা ভাষায় ইতালিয় সনেটরীতি প্রবর্তন করেন।
  • বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, ভাষার খেলাচ্ছলে উপস্থাপন ও মননশীলতা তাঁর প্রবন্ধকে কালজয়ী করেছে।

গুরুত্বপূর্ণ রচনা

প্রবন্ধ গ্রন্থ

  • তেল-নুন-লাকড়ী (১৯০৬)
  • বীরবলের হালখাতা (১৯১৬) — চলিত ভাষায় প্রথম গ্রন্থ
  • নানাকথা (১৯১৯)
  • আমাদের শিক্ষা (১৯২০)
  • নানাচর্চা (১৯৩২)
  • প্রবন্ধ সংগ্রহ (১ম খণ্ড ১৯৫২, ২য় খণ্ড ১৯৫৩)

গল্পগ্রন্থ

  • চার-ইয়ারী কথা (১৯১৬)
  • আহুতি (১৯১৯)
  • নীললোহিত (১৯৪১)
  • অনুকথা সপ্তক
  • ঘোষালে ত্রিকথা

কাব্যগ্রন্থ

  • সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩)
  • পদচারণ (১৯১৯)

পারিবারিক জীবন

তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে। তাঁর পরিবার ছিল সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারায় সমৃদ্ধ—যা তাঁর সাহিত্যচর্চাকে গভীরতর করে।

মৃত্যু

১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রমথ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি রেখে গেছেন এক অমর উত্তরাধিকার।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *