নির্মলেন্দু গুণ : জীবন, সাহিত্য ও অবদান
নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী (জন্ম: ২১ জুন ১৯৪৫; ৭ আষাঢ় ১৩৫২ বঙ্গাব্দ), বাংলা সাহিত্যজগতে নির্মলেন্দু গুণ নামে সুপরিচিত—তিনি আধুনিক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, গদ্যকার, ভ্রমণলেখক ও চিত্রশিল্পী। তাঁর কবিতা নারীপ্রেম, শ্রেণীসংগ্রাম, স্বদেশপ্রীতি, রাজনৈতিক নির্যাতন ও স্বৈরাচার-বিরোধিতার স্বরকে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরে।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ওই গ্রন্থের ঐতিহাসিক কবিতা ‘হুলিয়া’-র ওপর ভিত্তি করে পরে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর আরেক বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ আজ বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত।
সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (২০০১) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৬)।
প্রাথমিক জীবন
নির্মলেন্দু গুণ ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার কাশবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম রতন। পিতা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ ও মাতা বীণাপাণির দুই ছেলে ও তিন সন্তানের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। মাত্র চার বছর বয়সে মাতার মৃত্যু হলে তাঁর সৎমা চারুবালা-র কাছেই তিনি মানুষ হন, যিনি তাঁর শিক্ষা ও চরিত্রগঠনে গভীর ভূমিকা রাখেন।
শিক্ষাজীবন
চারুবালার হাতেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। পরে বারহাট্টার করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন।
- মেট্রিক (১৯৬২): দুই বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগ
- মেট্রিকের আগেই তাঁর প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’ মুদ্রিত হয় ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায়
- আই.এস.সি (১৯৬৪): ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগ; ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র নেত্রকোণা জেলার ছাত্র
- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে দাঙ্গার কারণে সুযোগ হারান; পরে B.A. প্রাইভেটে পাশ করেন (প্রাপ্ত হলেও সার্টিফিকেট তোলেননি)
- ১৯৬৫ সালে বুয়েটের লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন
- ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ লাভ করেন—মাসে ৪৫ টাকা এবং বছর শেষে ২৫০ টাকা, যা সে সময়ে প্রশংসনীয় বরাদ্দ ছিল
‘হুলিয়া’ কবিতার প্রসঙ্গ
১৯৭০ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘হুলিয়া’–র কয়েকটি লাইন বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিলস্বরূপ। কবিতায় তিনি আত্মগোপন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্রামজীবন, স্বজনদের উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা তুলে ধরেছেন। কবিতাটি পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভূ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
দাম্পত্য জীবন
১৯৮০ সালে তিনি নীরা গুণ-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাঁদের একমাত্র কন্যার নাম মৃত্তিকা গুণ।
কর্মজীবন ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
স্বাধীনতার পূর্বে নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক। সাংবাদিকতাতেও যুক্ত ছিলেন।
স্বাধীনতাত্তোর সময়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে, বিশেষ করে স্বৈরশাসন ও দুঃশাসনের প্রতিবাদে, তিনি ধারাবাহিকভাবে কণ্ঠ তুলেছেন।
সাহিত্যধারা ও বৈশিষ্ট্য
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা রবীন্দ্রনাথের মানবিক আবেগ ও সহজাত গীতিমাধুর্যের স্রোতে লালিত।
প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ—
- নারীপ্রেম, দেশপ্রেম, শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম
- স্বৈরাচার বিরোধিতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
- ছবিময় উপস্থাপনা ও কমনীয় ছন্দ
- ছন্দের পাশাপাশি গদ্যকাব্যের স্বচ্ছন্দ রূপ
- অনুভূতির সরলীকরণ ও রাজনৈতিক ক্ষোভের তীব্রতা
তিনি মনে করতেন—
“কাব্য যদি কন্যা হয়, গদ্য আমার পুত্র; উভয়ই আমার সৃষ্টিসন্তান।”
প্রধান পুরস্কার
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার – ১৯৮২
- একুশে পদক – ২০০১
- স্বাধীনতা পুরস্কার – ২০১৬
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ
কাব্যগ্রন্থ
(সিলেকশন)
- প্রেমাংশুর রক্ত চাই (১৯৭০)
- না প্রেমিক না বিপ্লবী (১৯৭২)
- অমিমাংসিত রমণী (১৯৭৩)
- চৈত্রের ভালোবাসা (১৯৭৫)
- বাংলার মাটি বাংলার জল (১৯৭৮)
- চাষাভুষার কাব্য (১৯৮১)
- অচল পদাবলী (১৯৮২)
- নিরঞ্জনের পৃথিবী (১৯৮৬)
- ধাবমান হরিণের দ্যুতি (১৯৯২)
- কাব্যসমগ্র (১ম–২য় খণ্ড, ১৯৯২–১৯৯৩)
- অনন্ত বরফবীথি (১৯৯৩)
- আনন্দউদ্যান (১৯৯৫)
- ইয়াহিয়াকাল (১৯৯৮)
- আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি (২০০০)
- বাৎস্যায়ন (২০০০)
গল্পগ্রন্থ
- আপন দলের মানুষ
- পোড়ামাটি
ছড়ার বই
- সোনার কুঠার (১৯৮৭)
আত্মজীবনীমূলক রচনা
- আমার ছেলেবেলা
- আমার কণ্ঠস্বর
- আত্মকথা ১৯৭১ (২০০৮)
অনুবাদ
- রক্ত আর ফুলগুলি (১৯৮৩)
