ড. সলিমুল্লাহ খান : আত্মজীবনী
আমার জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের অপরূপ জেলা কক্সবাজারে। আমার শৈশব কেটেছে সমুদ্র-নদী-পাহাড়ঘেরা এক দ্বীপ, মহেশখালীতে। প্রকৃতির কঠিন সৌন্দর্য ও মানুষের আন্তরিক জীবনের স্পর্শ খুব অল্প বয়সেই আমাকে জিজ্ঞাসু করে তুলে। পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন; আমি চতুর্থ। আমার বাবা ছিলেন একসময়কার স্থানীয় রাজনীতির পরিচিত মুখ—মানুষের সমস্যা, তাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব খুব কাছে থেকে দেখা সেই ছোটবেলার দিনগুলো পরবর্তী জীবনে আমার ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
আমাদের নানাবাড়ি ছিল কালার মার ছড়া, কক্সবাজারে। ওই জায়গার স্মৃতি এখনো আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সবুজ ছায়া, নোনাজল, দমকা বাতাস আর সাথেসাথে মানুষের সহজ, প্রাকৃতিক জীবনের দিকে। বহু বছর পর যখন সমাজ, রাষ্ট্র বা উপনিবেশবাদ নিয়ে গবেষণা করেছি, তখন বুঝেছি—মানুষের দুঃখগুলো অনেক পুরনো, কিন্তু সেই দুঃখকে ভাষা দেওয়ার দায়িত্ব বুদ্ধিজীবীদের।
শিক্ষাজীবনের শুরু
আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে, যেখানে আমি মাধ্যমিক পাশ করি। এরপর ভর্তি হই চট্টগ্রাম কলেজে। উচ্চমাধ্যমিকের সময় বই, রাজনীতি ও চিন্তার জগতে আমার প্রথম আসল প্রবেশ ঘটে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে (LLB) ভর্তি হই।
ঢাকায় এসে আমি মানুষের, সমাজের ও রাষ্ট্রের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলো একটু একটু করে খুঁজে পেতে থাকি। ছাত্রজীবনে ১৯৭৬ সালে আমার পরিচয় হয় আহমদ ছফা–র সঙ্গে। তাঁর মতো বিবেকবান, দুঃসাহসী, মেধাবী মানুষ বাংলায় খুব কমই জন্মেছে। ছফা ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হলো অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক–এর সঙ্গে। এই দুই ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব আমার চিন্তাশক্তির ভিত্তি নির্মাণ করেছে।
একসময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থাকলেও রাজনৈতিক দলীয় আনুগত্য কখনোই আমার স্বভাবের সঙ্গে যায়নি। আমার তীব্র আগ্রহ ছিল—ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক তত্ত্বে।
যুক্তরাষ্ট্রজীবন ও উচ্চতর গবেষণা
১৯৮৬ সালে আমি বৃত্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাই। নিউ ইয়র্কের The New School for Social Research–এ আমি বহু বছর গবেষণা করি। এ সময়েই গড়ে ওঠে আমার তাত্ত্বিক পরিচয়—মার্কসবাদ, ফুকো, বেঞ্জামিন, সাইদ, ফানোঁ, লেভি-স্ত্রস, তালাল আসাদ—যারা পরবর্তীতে আমার লেখার বুননে রক্তের মতো বয়ে চলেছে।
আমার পিএইচডি-র অভিসন্দর্ভ ছিল—
“England’s Central Banking Theory, 1793–1877”
এই গবেষণায় আমি ইউরোপের অর্থনৈতিক ইতিহাস, ব্যাংকিং তত্ত্ব ও উপনিবেশিক আধিপত্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনুসন্ধান করি।
নিউ ইয়র্কে থাকার সময়ই আমি বুঝতে শিখি—পশ্চিম কি ভাবে বিশ্বকে দেখে, এবং আমরা—উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রসমূহ—নিজেদের কিভাবে দেখি। এই দ্বন্দ্বই পরবর্তীকালে আমার সমগ্র রচনার কেন্দ্রে অবস্থান নেয়।
কর্মজীবন : শিক্ষকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা
১৯৮৩-৮৪ সালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করি। কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে শিক্ষকতা করি। এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং অবশেষে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ULAB)–এ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। বর্তমানে আমি Center for Advanced Theory (CAT)–এর পরিচালক হিসেবে কাজ করছি।
শিক্ষকতা আমার কাছে শুধু পেশা নয়; এটি মানুষের বোধ, সাহস এবং পরিবর্তনের সক্ষমতা তৈরি করার কাজ। ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে আমি সবসময় জোর দিয়েছি—চিন্তার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার ক্ষমতা, এবং ইতিহাসকে নিজের চোখে নতুনভাবে দেখার শক্তি।
আমি একইসঙ্গে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নিবন্ধিত অ্যাডভোকেট, এবং আইনের জগৎ আমাকে রাষ্ট্র-আইন-নাগরিক সম্পর্কের জটিলতা বোঝার আরেকটি জানালা দিয়েছে।
চিন্তা, তত্ত্ব ও মতবাদ
আমার চিন্তার ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে—
- কার্ল মার্ক্স
- জাক লাকাঁ
- আহমদ ছফা
- ফ্রানৎস ফানোঁ
- ওয়াল্টার বেঞ্জামিন
- মিশেল ফুকো
- এডওয়ার্ড সাইদ
- তালাল আসাদ
এই চিন্তকদের মাধ্যমে আমি শিখেছি—
রাষ্ট্রের প্রকৃতি, ক্ষমতার নেপথ্য, উপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব, জ্ঞান উৎপাদনের রাজনীতি, এবং ভাষার শক্তি।
আমার লেখালিখি তাই প্রায়ই সমালোচনাধর্মী, উপনিবেশবাদবিরোধী এবং রাষ্ট্র-সমাজের অন্তর্গত অসাম্যের বিরুদ্ধে।
লেখালেখি : বই, প্রবন্ধ ও অনুবাদ
আমার বইয়ের সংখ্যা অনেক; এর মধ্যে—
প্রবন্ধ-গদ্য
- বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচ্চিত্র (১৯৮৩)
- সাইলেন্স: অন ক্রাইম অব পাওয়ার (২০০৯)
- স্বাধীনতা ব্যবসায়
- বেহাত বিপ্লব ১৯৭১
- গরিবের রবীন্দ্রনাথ
- বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নের সমস্যা ও সম্ভাবনা
- ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় (২০২৩)
- উৎসর্গ: পরিবার প্রজাতি রাষ্ট্র (২০২৩)
অনুবাদ
- প্লেটোর লেখা (বাংলা)
- শার্ল বোদলেয়ার
- ফ্রানৎস ফানোঁ
- ডরোথি জুল্লে
- পেন্টি সারিকস্কির কবিতা
কবিতা
- এক আকশের স্বপ্ন (১৯৮১)
প্রয়োজনের তাগিদে আমি বহু বছর ধরেই বাংলা সাধুভাষায় লেখালেখি করছি। ভাষা আমার কাছে শুধু যোগাযোগ নয়; এটি রাজনৈতিক শক্তি। আমি বারবার বলেছি—বাংলাদেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকেই বাংলা ভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
বাংলাদেশ, রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে চিন্তা
আমি সবসময়ই বলেছি—
স্বাধীনতা অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া অর্থহীন।
সমাজের প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী।
সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না।
বেহাত বিপ্লব ১৯৭১–এ আমি লিখেছি জাতির তিন মূলনীতি—
- সাম্য
- মানবিক মর্যাদা
- সামাজিক ন্যায়বিচার
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার প্রচেষ্টা, যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী মনোভাব, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান—সব ক্ষেত্রেই আমি স্পষ্ট ও নির্ভীক অবস্থান নিয়েছি।
২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনে আমি অংশগ্রহণ করি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি।
সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমি বহুবার বলেছি—ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ রোপণ করেছে। বাংলাদেশে যদি ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করতে হয়, তবে রাষ্ট্রকে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিভিন্ন সমালোচনা, বিতর্ক ও অবস্থান
লেখালেখিতে আমি কখনো পর diplomatically ভুলতে পারিনি।
তাই সমালোচকও কম নয়।
ড. গোলাম মুরশিদের নজরুল–সম্পর্কিত বক্তব্য যখন অশালীন ও ভিত্তিহীন মনে হয়েছে, আমি কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেছি। আমার মতে সাহিত্য সমালোচনা নোংরামি নয়—যুক্তি, নৈতিকতা ও সত্যের ওপর দাঁড়াতে হবে।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
- রনজিত পুরস্কার (২০২০)
- লোক’ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭)
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ (প্রবন্ধ/গদ্য)
এই পুরস্কারগুলো আমাকে আনন্দ দেয়, কিন্তু লেখালেখি বা চিন্তার মূল প্রেরণা কখনোই পুরস্কার নয়—বরং অন্যায়, অসাম্য ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে লড়াই করার তাগিদ।
ব্যক্তিজীবন
আমি সুখী হয়েছি বই, শিক্ষকতা ও চিন্তাশীল মানুষের সহচর্যে। আমি বিশ্বাস করি—
“মানুষের মুক্তিই চিন্তার শেষ লক্ষ্য।”
আমার জীবনে যে সব মানুষ—শিক্ষক, সহচর, ছাত্র, পাঠক—তারা সবাই আমার চিন্তা ও চরিত্র নির্মাণে অংশ নিয়েছেন।
নিজের প্রতি নিজের দায়
আমি মনে করি, বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব কেবল লেখালেখি নয়—সত্য বলা।
যেখানে অন্যায়, সেখানে প্রতিবাদ।
যেখানে অন্ধকার, সেখানে প্রশ্ন।
যেখানে মৌনতা, সেখানে শব্দ।
আমি চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন বাংলাদেশ দেখুক—
যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা আছে, ভাষার মর্যাদা আছে, মানুষের সম্মান আছে।
যদি আমার রচনা, কথা বা শিক্ষাদান—কিন্তু সামান্য পরিমাণেও—মানুষকে জাগায়, প্রশ্ন করতে শেখায় বা সত্য খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করে, তবেই আমার জীবন অর্থবহ।
