জলের লিখন

জলের লিখন : রোমান্টিকতা ও দেশেপ্রেমের পূর্ণ ক্যানভাস

জলের লিখন : রোমান্টিকতা ও দেশেপ্রেমের পূর্ণ ক্যানভাস
মুনশি আলিম

মোজাম্মেল হক নিয়োগী বাংলা কথাসাহিত্যের এক আলোচিত নাম। নিয়োগী’র জলের লিখন উপন্যাসটি তাঁর তেরোতম রচনা। সমাজের প্রান্তজনদের নিয়েই তার রচনার মূল আকর্ষণ। উপন্যাসে দর্পণের মতো ফুটে উঠেছে এনজিও’র ভেতর ও বাহিরের নিটোল ক্যানভাস। প্রকৃত অর্থে লেখকের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতারই ছায়াপাত ঘটেছে এ উপন্যাসে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের মতোই ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাস শুরু করেছেন বর্ষা ঋতু দিয়ে। উপন্যাসটি উত্তম পক্ষে বর্ণিত। পাহাড়ি রাস্তার মতো এ উপন্যাসে রয়েছে ঘটনার বাক্প্রবাহ। সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই রয়েছে সুসামঞ্জস্যতা। কেন্দ্রীয়চরিত্র মারিয়াকে কেন্দ্র করে মূলত এ উপন্যাসের ক্রম সাজানো হয়েছে। ফুলের মতোই শ্বেতশুভ্র মারিয়া। কিন্তু সামাজিক পরিচয়ের দলিলদস্তাবেজে সে একজন যুদ্ধকন্যা। একাত্তরে যার মা অপশক্তি দ্বারা ধর্ষিত হয়। পরবর্তীকালে বিদেশের স্বেচ্ছাসেবী আশ্রয়ে মানুষ হয় এবং নামকরণ হয় মারিয়া।

পূর্ণ সাবালিকা হওয়ার পর তার মনের ভিতর গুমরে ওঠে আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশে এসে সে গ্রামীণ সমাজজীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে সারা বাংলা চষে বেড়ায়। বাংলা একবারেই বলতে পারে না। ফলে বাংলাদেশে তার গাইড হিসেবে নিয়োগ পায় উপন্যাসের নায়ক আতিক। মারিয়ার আরেক সহচরী পারভিন মারিয়ার মতোই ট্র্যাজেডির শিকার। পিতৃপরিচয়হীন গর্ভের সন্তানটি তার এক আত্মীয়ের কাছে বড়ো হয়। মূলত এই দুই নারীর চাপা কান্নাই নায়কের মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সমস্ত উপন্যাস জুড়ে এই তিন চরিত্রের হৃদয়রহস্য ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠেছে।

চরিত্রচিত্রণে ঔপন্যাসিক যেনো এক দক্ষ কারিগর। ঔপন্যাসিকের লেখনির সূ² আঁচরে পার্শ¦চরিত্র নাফিজা, তুহিন, আসমা, রুস্তম, হাসু খালা, রূমালি, কবির, জিম, অ্যাঙ্গেলা, বিগগ্রেট, ব্রিজিড, মাইক, এরিক প্রমুখ প্রাণ পেয়েছে। পাশাপাশি প্রধান চরিত্রের সঙ্গেও এসব চরিত্রের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজেস ও সুসামঞ্জস্যতা। মূলত এসব চরিত্রের কারণেই প্রধান চরিত্রত্রয় ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

ভাষার সরলীকরণ অত্যন্ত চমৎকার। চরিত্র অনুযায়ী সংলাপের বুনন সত্যিই যথার্থ। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পঠনপাঠনে পাঠক ঘটনার পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত¡ এবং তথ্যও খুঁজে বেড়ায়; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় কাব্যময়তা, অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় আত্মাতিকতার সুঘ্রাণ আর মোজাম্মেল হক নিয়োগীর উপন্যাসে পাওয়া যায় কঠিন বাস্তবতার সুঘ্রাণ!

অবশ্য একই সঙ্গে কাব্যময়তা এবং দার্শনিক তত্ত¡ও কম নয়। কিছু চুম্বক অংশ :
 তোলো ছবি, এগুলো শুধু তোমার মনের একপ্রস্থ সুখই দিতে পারবে, কোনো কাজে আসবে না।
 শাওনের আসমান বড় রঙিলা। এই মেঘ এই রোদ।
 আমার মনে হয় ঘুম ও বৃষ্টি দুটিই স্বর্গীয় ব্যাপার। মনে হয় জটিল শব্দ দিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে দিয়ে জোর করে কবিতা বানায়। কবিতা তো বানানোর জিনিস নয়। অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।
 আকাশ বৃষ্টিতে কেবল ¯œান সেরেছে। আমার বুকের ভেতর কাইত্তান শুরু হয়ে গেছে।
 মারিয়া একটু হাসে। সকালের দৃষ্টি বিনিময় ও হাসির দ্বিতীয় সংস্করণ এটি।
 জটিল ভাবনাই মনোহগতের জটিল দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি করে, জীবন বিষময় হয়ে ওঠে।
 বলতে পারো আমি যুদ্ধশিশু, যুদ্ধকন্যা।
 সারা পৃথিবীতে হয়ত চাপাবাজদের মূল্য আছে। এটা কথা বলার আর্ট, দক্ষতা। সব মানুষের এ আর্ট বা দক্ষতা থাকে না।
 সূর্য থেকে সমস্ত রোদটুকু শুষে নিয়ে শুধু ছায়াটুকু দেয় ছোটো ছোটো গাছ আর লতাগুল্মকে।
 পাকা ধানের মতো পারভিনের মুখে সলজ্জ হাসি ছড়িয়ে আছে।
 কোনো কোনো পাখি রোদেলা আকাশে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ছে। পাখিরা ভালো আছে। জীবন নিয়ে তাদের এতো ভাবনা নেই।
 জীবন কী? একটা রাসায়নিক শক্তির মিথস্ক্র্রিয়া মাত্র। শক্তি কমে গেলেই পথের কুকুরের মতো অধম।
 ভাবাবেগের ধারালো ছোরায় ক্ষত বিক্ষত হৃদয়।
 হলুদের মতো শরীরের রঙ।
 রক্তমাংসের শরীর বলেই মনোজগতে ঝড়তুফান। আমার মনের ভেতর আমার অতীত খুঁচিয়ে যায় অবিশ্রাম।
 দুঃসংবাদ শুনলে মানুষের শরীরের শক্তি কমে আসে।
 এর নাম অইল মজা ভিটামিন।
 বয়সের কারণেও পারসেপশনে পরিবর্তন হয়। পারসেপশন ধ্রæব সত্য নয়, ধ্রæব সত্য বয়স।
 মনে হচ্ছে আমি কোনো গভীর অন্ধকার সমুদ্রের ভেতরে ডুবে যাচ্ছি।
 জীবনখেলায় যদি উত্থান-পতন না থাকে তবে সে জীবনকে উপভোগ করা যায় না।
 এ দেশের ষড়ঋতুর মতোই আমার জীবন। মানুষের ভাবনা হলো সুখ দুঃখের খতিয়ান, হাসি-কান্নার ট্রেজারি।
 বিমূর্ত রাতের মলাটে সহজিয়া জোছনাকাব্যও বিমূর্ত।
 অন্ধকারেও কেমন আলোর ঝিলিক দিচ্ছে।
 কুয়াশার সামিয়ানায় আকাশও ঢাকা। সূর্য নেই ডুবে আছে কুয়াশার খাদে।
 নদীর যত বাঁক নদী তত সুন্দর। যে জীবনের যত বেশি বাঁক সে জীবনও তত সুন্দর।

পৃথিবীর সব দেশেই শাসন ও শোষণের চিত্র রয়েছে। এটা প্রাচীনকালেও যেমন ছিল বর্তমানকালেও রয়েছে; কেবল ধরন একটু বদলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরে এদেশে বেসরকারি সংস্থাগুলো জনকল্যাণের নাম করে খুব কৌশলীভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সাধারণের কাছ থেকে শোষণ করে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। রাতারাতি কেউ কেউ আঙুল ফুলেও কলাগাছ বনে যাচ্ছে। নি¤œবিত্তদের ব্যবহার করে বিদেশি দাতব্যসংগুলোর কাছ থেকে এনজিও মালিকরা লুফে নিচ্ছে বড়ো অংকের টাকা। নিঃসন্দেহে ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়েছে এ উপন্যাসটিতে। কেননা, ব্যক্তিজীবনে এ সংস্থার সঙ্গে বিস্তর পরিচয় থাকার কারণেই তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। এককথায় এনজিও তথা বেসরকারি সংস্থাগুলোর চরিত্র একেবারে উলঙ্গ করে ছেড়েছেন।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রের চেতনা। প্রকারান্তরে এটি স্বদেশচেতনা, মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনা। সবগুলো চরিত্রকেই খুব আপন মনে হয়। মনে হয় যেনো হাজার বছরের পরিচিত। জলের লিখন মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আশ্রিত দেশেপ্রেমের নিটোল মাহাত্ম্যগাথা।
৯৯ পৃষ্ঠায় পরিচ্ছদ আকারে ১২ লেখা আছে। আগে পরে কোনো পরিচ্ছদের নামাঙ্করণ নেই। এর মাহাত্ম্য ঠিক বুঝা গেল না। উপন্যাসের শেষের দিকে জিম, অ্যাঙ্গেলা, বিগগ্রেট, ব্রিজিড, মাইক, এরিক প্রমুখদের আগমন না ঘটলেও উপন্যাসের তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। ধর্মের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করেও ঔপন্যাসিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেননি।

বাংলা কথাসাহিত্যে কোনো নায়ককে স্বশিক্ষিত হয়ে এলিট জীবনে পদার্পণ নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলা সিনেমাতেও এটা বিরল নয়। লেখকের উদ্দেশ্য মহৎ। উপন্যাসের নায়ক আতিক। যে প্রতিমুহূর্তেই নিজেকে নিজের সততা, আত্মবিশ্বাস ও প্রচেষ্টার সৎগুণে উতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। রোমান্টিকতা তার ওপরে ছায়াপাত করে কিন্তু ভর করে না। রক্তমাংসের মানুষ হয়েও সে হয়ে উঠছে কামহীন, ক্লেদহীন। দীর্ঘ সময় কাছে পেয়েও নায়িকার সঙ্গে তার কোনোরূপ কমপ্লেক্স অনুভূতি নেই, কোনোরূপ কামভাব নেই। প্রেমটাও জোরালো নয়। মনে হয় কৃত্তিম অনুভূতি দ্বারা অঙ্কিত আতিকের হৃদয় ক্যানভাস। ফলে চরিত্রটিকে খুব পরিচিত এবং লোভনীয় মনে হলেও অনেকটা রক্তমাংসের বলে মনে হয় না। হুমায়ুন আহমেদ তার বিশেষ চরিত্র হিমুর ক্ষেত্রে যেমন উদাস উদাস ভাব রেখেছেন তেমনই ভাব দেখতে পাই আলোচ্য উপন্যাসের আতিকের মধ্যে।

তবে জলের লিখন উপন্যাস কখনো সখনো পাঠকমনকে ক্ষতবিক্ষত করে। কখনো বা রোমান্টিকতার ভেলায় চরিয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তরে। দেশপ্রেমের নিটোল চিত্র মেলে নায়কের বর্ণনায় :
যুদ্ধের সময় তো অনেক শিশুরই জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। মারিয়া হয়তো তাদেরই একজন। চাঁদের আলোয় আমি তাকে আপাদমস্তক দেখলাম। মনে হলো আমার সামনে শুয়ে আছে শ্যামলসুন্দর এক বাংলাদেশ। আমি মারিয়ার মধ্যে দেখতে পাই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে সুরমা-বিস্তৃত এক সমতল ভূমিতে উৎর্কীর্ণ হয়ে আছে হাজারো নদী অরণ্যের ¯িœগ্ধ শ্যামল ছায়াময় বাংলার শ্বাশত রূপ মাধুর্য।

যুদ্ধকন্যা বা যুদ্ধশিশুর সামাজিক প্রেক্ষাপট, চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সুনিপুন উপস্থাপনে উপন্যাসটিতে সংযোজিত হয়েছে ভিন্নমাত্রা। কাহিনির পরম্পরা রক্ষায় ঔপন্যাসিক খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ঘটনার সন্নিবেশে সময়ের ঐক্য ও পরম্পরা রক্ষায় ঔপন্যাসিকের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। দীনেশচন্দ্র সেন জীবনানন্দের কবিতা পড়ে বলেছিলেন—কবি, আমি তোমার কবিতা পড়ে কেঁদেছি। জলের লিখন উপন্যাস পঠনপাঠনেও পাঠকের হৃদয় কখনো ভারাক্রান্ত হবে, কখনো চোখ হবে অশ্রæসিক্ত! একজন সার্থক ঔপন্যাসিক ঠিক ওই জায়গাতেই সফল। কথার বুনন, ঘটনার পরম্পরা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সময়ের ঐক্য, ইতিহাসের যথোপযুক্ত সন্নিবেশ, বাস্তবতার নির্যাস, কাব্যময়তা, দার্শনিক পদবাচ্যের যথার্থ প্রয়োগ, ঘটনার বাস্তবতা, স্থানের ঐক্য, পটভূমির সুনিপুণ উপস্থাপনসহ যে দিক থেকেই তাঁর উপন্যাসকে বিশ্লেষণ করা হোক না কেন—সব দিক থেকেই তাঁর উপন্যাস নন্দিত; কাজেই তাঁর এই অর্জনকে বাংলা কথাসাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে মাইলফলকস্বরূপ বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *