ঘূর্ণিবায়ু ও ধূসর কাবিন

ঘূণিবায়ু ও ধূসরকাবিন : রোমান্টিক আবহে মানবমনের গভীর পাঠ

ঘূণিবায়ু ও ধূসরকাবিন : রোমান্টিক আবহে মানবমনের গভীর পাঠ।
মুনশি আলিম

বাংলা কথাসাহিত্যে মোজাম্মেল হক নিয়োগী এক আলোচিত নাম। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশুতোষ, অনুবাদ, গবেষণা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই রয়েছে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ। তিনি মূলধারার একজন প্রতিভাবান লেখক। একটি-দুটি করে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় সেঞ্চুরির কাছাকাছি। লিখেছেন বেশি কিন্তু সেই তুলনায় আলোচনায় এসেছেন কম। তিনি একটু আলো-আঁধারি সময়ই অতিক্রম করছেন। তবে খুবই শীঘ্রই তিনি জাতীয়ভাবে আলোচিত হবার দাবি রাখেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর অবাধবিচরণ থাকলেও কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি অগ্রগণ্য। কথার বুননে তিনি সিদ্ধ কারিগর। তাঁর যেসব উপন্যাস বাস্তবতার পটভূমি নিয়ে লেখা তন্মধ্যে তাঁর ঘূর্ণিবায়ু ও ধূসরকাবিন অন্যতম। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পুরো উপন্যাসটিকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী আবহ। মানবমনের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে তিনি সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন নারী-পুরুষ চরিত্রের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত নানা দিক। বাস্তবতার সুঘ্রাণমাখা ঘটনাগুলোকে তিনি সহজসরল ভাষা ও শিল্পরসে পাঠকহৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন।

ঘূর্ণিবায়ু ও ধূসরকাবিন উপন্যাসটি মোট ২৫টি পর্বে বা অনুচ্ছেদে বিভক্ত। ২০১৬ সালে বইটি প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। বইটির খুচরা মূল্য ধরা হয়েছে ২৬০ টাকা। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের বৈকালিক সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নাদিরা। নাদিরার মতোই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নির্মল। মূলত নাদিরা ও নির্মলের প্রেমকাহিনিই এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। দুজন দুই ধর্মের অনুসারী। তারা দুজনেই একটি এনজিওতে কাজ করে; তাও আবার একই অফিসে।

এ উপন্যাসের পটভূমি কয়েক জেলা ও উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত। বিশেষ করে কুমিল্লা, যশোর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রৌমারী, ইটনা, প্রভৃতি স্থানগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘূর্ণিবায়ু ও ধূসরকাবিন উপন্যাসের শুরুই অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা দিয়ে অর্থাৎ তিনি শুরু করেছেন কাব্যময়তা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসে ইউরোপের পাঠকরা কেবল ফিলোসফি বা দর্শন খোঁজে; তারা তাঁকে যতটা না ঔপন্যাসিক মনে করে তাঁর চেয়েও বেশি ফিলোসফার মনে করে। মোজাম্মেল হক নিয়োগী এ থেকে একটু ব্যতিক্রম। তাঁর উপন্যাসে শুধু দর্শনই নয় পাশাপাশি কাব্যময়তায়ও ভরপুর। তাঁর উপন্যাস পাঠনপাঠনে একজন প্রকৃতপাঠক আস্বাদন করবে নানা রস। কাব্যময়তায় কখনো কখনো মনে হবে যেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর সুঘ্রাণ। চরিত্র চিত্রণে তিনি এক দক্ষ কারিগর।

নাটকীয়তা নয়, বরং কাব্যিক ক্যানভাসে উপন্যাসের শুরু। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রথম দেখা হয় কেন্দ্রীয় চরিত্র নাদিরার সঙ্গে নির্মলের। তারা ৩০ দিনের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণে এসেছে। সহকর্মীও ৩০ জন। তাদের প্রশিক্ষক মাহমুদা নামের একজন মহিলা। যার কথাবার্তা ও উপস্থাপনা খুবই গোছালো। এ প্রশিক্ষণের একজন স্পষ্টভাষী কর্মী রফিক। সে যেমন রসিক, সৎসাহসী, তেমনই উদ্যমী। নাদিরার সঙ্গে সে খোলামেলা আলাপ করতো। নাদিরাও তার স্পষ্টবাদিতা আর উদ্যমতাকে পছন্দ করতো, উৎসাহ দিত। নাদিরার মুল বাড়ি কুমিল্লায়। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরপরই পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে বেসরকারি সংস্থায় তাকে চাকরি নিতে হয়।

পিতা সাবের আহমেদ একটু রাগী প্রকৃতির মানুষ। লেখকের ভাষায়Ñ“কড়া চালভাজার মতো মেজাজের একজন বাবা”। মা আফিয়া বেগম খুবই শান্ত প্রকৃতির। তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে সাবের সাহেবের সঙ্গে সংসার করছেন। একমাত্র ছোটোভাই সজীব; যাকে পরিবারের অর্ধেক সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য দেওয়া হয়েছিল।

নাদিরার সহকর্মী আজিম নির্মলের বন্ধু। তার আরেক সহকর্মী অঞ্জীল। মূলত তাদের কাজ হলো মাঠপর্যায়ের। নির্মল শ্যামবর্ণের টগবগে হিন্দু যুবক। ভালো গানও গায়। তিনবোন, বাবা প্যারালাইসিস রোগী, মা গৃহিণী, বড়োভাই মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা বসবাস করছে। উপন্যাসে দেখতে পাই রফিকের মেধা, আত্মবিশ^াস ও পরিশ্রমের কারণেই তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে।

চাকরির সুবাদে প্রায় প্রত্যহই নাদিরা ও নির্মলের একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়। একসময় নাদিরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীর্ঘ দশদিন জ¦রের সঙ্গে লড়ে সুস্থ হয় নাদিরা। আর এ দশদিনই নির্মল তাকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা, সেবা-শুশ্রæষা করেছে। এতে ধীরে ধীরে গলে যায় নাদিরার কঠিন হৃদয়। নির্মলের নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের কাছে দীর্ঘ সময় পার করে হলেও এক সময় হার মানে নাদিরা। তখন উভয়ের চোখে উড়তে থাকে হাজার হাজার পায়রা। অর্থাৎ তারা দুজনেই জড়িয়ে পড়ে গভীর প্রেমে। দুজনেই জানে তাদের প্রেমের পথে শত কাঁটা, শত বাঁধা।

উপন্যাসের কোনো কোনো ঘটনাকে তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। উপন্যাসিক ব্যক্তিজীবনেও এনজিওকর্মীদের নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবলোকন করেছেন। এককথায় এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিজীবনেরই ছায়াপাত ঘটেছে। অন্যভাবে বললে বলতেই হয়Ñএ উপন্যাসটি তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার ফসল। এনজিওর চাকরির নিয়মগুলো একটু কঠিন। একই প্রতিষ্ঠানে স্বামী-স্ত্রী চাকরি করতে পারে না। আর এ কারণে নাদিরার সহকর্মী সায়মা বড়ো কর্তার প্রেমে পড়ে ও পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে তাকে বিয়ে করে।

উপন্যাসের গুরুত্ব বাড়াতে কোথাও কোথাও ইতিহাসের চরিত্রের ছায়াপাত ঘটানো হয়েছে। সবচেয়ে ভালোলাগার বিষয় হলো কোনোকিছু বুঝাতে তাঁর নিখুঁত উপমার ব্যবহার। চরিত্র অনুযায়ী যুতসই সংলাপ পুরো উপন্যাসটিকে দিয়েছে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা।

উপন্যাসে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মিথস্ক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দুই ধর্মের মেলবন্ধন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে বৈবাহিক বন্ধন। কিন্তু সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়ই এটা। সামাজিক সীমাবদ্ধতা প্রাচীনকালে বা মধ্যযুগে যেমন ছিল ঠিক তেমনই এ যুগেও এ নিয়মের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। যদিও শিক্ষার হার বেড়েছে সে তুলনায় অনেকগুণ বেশি। তিনি দুই ধর্মের নাদিরা ও নির্মলকে বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু তিনি থেকেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে মানিকের সত্ত¡াকে যতটুকু স্পষ্ট বুঝা যায় এ উপন্যাসে তিনি ততটুকু প্রকাশিত হননি। সমকালীন দেশীয় প্রেক্ষাপটে এমনটি ঘটা খুবই স¦াভাবিক। কেননা, এ দেশে মুক্তচিন্তার সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রকৃত সমালোচনারও সুযোগ নেই। না রাজনৈতিক, না সামাজিক, না সাহিত্যজগতে! তবে একজন প্রকৃতপাঠক অনায়াসেই বুঝে ফেলবে ঔপন্যাসিকের অসাম্প্রদায়িক চেতনার দর্শন।

প্রেম সত্যি মানুষকে বোকা বানায়। প্রেমিকের কাছে তখন প্রেমিকার সবকিছুই ভালো লাগে। যেভাবে লাইলী-মজনু উপাখ্যানের মজনুর ভালো লাগত লাইলীর বাড়ির কুকুরটাকেও। প্রেমাসক্ত হওয়ার পরে নির্মলও কেমন বদলে যায়। বদলে যায় তার চিন্তাধারা। তার ভেতরে নতুন নির্মলের জন্ম হয়। নাদিরার প্রেম তাকে প্রেমান্ধ করে তোলে। আর একারণেই আমরা দেখতে পাইÑনির্মলের মুখেই নাদিরার ধর্মের আচারের কথা! সে তাকে নামাজের পাশাপাশি বোরকা পরার কথাও বলে।

নাদিরা ট্রান্সফার হলেও তার বাসা ঠিক করে দেয় নির্মল। রেলকর্মচারী হাফিজের স্ত্রীর নাম আলো। তার বাসার সঙ্গেই বাসাভাড়া করে দেয় নির্মল। আর এ সুবাদে প্রায়ই সে তার বাসায় যাতায়াত করতে শুরু করে। প্রথমটাতে যেনো বিছানা থেকে উঠতেই চাইত না নির্মল। ঔপন্যাসিকের ভাষায়Ñ“জামার বোতামের মতো লেগে আছে বিছানার সঙ্গে!”

তাঁর উপন্যাসে কিছু নতুন ও অপরিচিত শব্দ যুক্ত হয়েছে। শব্দগুলোকে তিনি আবার যুতসই ব্যবহার করেছেন। যেমন ব্রীড়ানত, পয়মন্ত, পলেস্তরা প্রভৃতি। অবশ্য এর চেয়ে আরও সহজ শব্দ তিনি ব্যবহার করেত পারতেন। মূলত এ উপন্যাসে এনজিওকর্মীদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পটভূমিই শৈল্পিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

ধর্মান্তকরণের চেষ্টা, মৃত্যুক্ষুধাতে দেখতে পাই কখনো কৌশলে কখনোবা জোর করে ধর্মান্তকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এ উপন্যাসে তেমনটি না থাকলেও রোমান্টিক প্রেমের ঘনঘটা আছে। দুর্বার আবেগে দলিতমথিত হয় নির্মল। আর এ কারণে তার কাছে ধর্মও তুচ্ছ হয়।

দশম পর্বে নাদিরা ও নির্মলের মধ্যে প্রথম রোমান্টিক ভাব ও স্পর্শের মেরুকরণ ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা সর্বদাই তাদের অদৃশ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সুন্দরী নাদিরার জন্য অনেকেই পাগল। রাস্তার যুবক-পথিকরা পর্যন্তও তার দিকে আড়চোখে তাকায়। বিশেষ করে মনোয়ার নামক এক ব্যবসায়ী তো রীতিমতো তার জন্য পাগল। শেষপর্যন্ত তাকে কিডনাফ করার ষড়যন্ত্র সে করতে চায়।

সব বাঁধাকে তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই গোপনে দুজনে বিয়ে করে কোনো এক মাজারে গিয়ে। কিন্তু এই গোপন বিয়ে কোনো সময়ই আলোর মুখ দেখেনি। লুকিয়ে লুকিয়েই তাদের সংসার করতে হয়েছে। অন্ধকার আর আলোছায়ার হেয়ালি খেলা যেন তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে যায়। সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, দারিদ্য ইত্যাদিও বাঁধা তাদের বিয়ের সম্পর্ক দুজন ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো মানুষকে জানাতে সাহস পায়নি। একসময় নাদিরার প্রমোশন হয়। এবং নারিরাই নির্মলের বস হয়।

উপন্যাসের আবেগীয় ঘনঘটা, বর্ণনার চমৎকারিত্ব যেকোনো পাঠককে ধরে রাখবে বলে আমার বিশ^াস। আবার কোনো কোনো কাব্যিক বা দার্শনিক লাইনও পাঠককে অনায়াসে ভাবিয়ে তুলতে পারে। উপন্যাসের গভীর সত্যগুলো বাস্তবতা থেকেই উঠে আসে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন এ সমাজে মানুষের জীবনের চয়ে ধর্মই বড়ো। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সেই বিখ্যাত উক্তির সঙ্গে যেনো কিছুটা সাদৃশ্য মিলেÑ“এখানে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি।”

নাদিরা ও নির্মল দুজনই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ঔপন্যাসিক অত্যন্ত সুচারুরূপেই মধ্যবিত্ত পরিবারের চালচিত্র নিখুঁত ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নাদিরার চাকরির চার বছর হলে তাকে ফরিদপুরে পোস্টিং দেওয়া হয়। ভাগ্যক্রমে সেখানে নির্মলেরও চাকরি হয়। আর সেখানেই নির্মলের সঙ্গে নাদিরার বিয়ে হয় নতুন নামে। নির্মলের নাম মেহেদী এবং তার পিতার নাম হয় আবুল কালাম আজাদ! বাসর হয় বন্ধবী মীনাক্ষীদের বাসায়। সেখানে নাদিরার নামÑনীলাঞ্জনা প্রামাণিক। এর কিছুদিন পরই মধুখালিতে আবার পোস্টিং হয়। এরই মধ্যে নাদিরারও প্রমোশন হয়। আর এ কারণে নির্মল কাজে একটু দেরিতে যেত। এটা অবশ্য গোপন থাকত না। সহকর্মী লতিফ বলেন-আপনি কাজে যাওয়ার সময় এমন করেন কেন?

চৈতালী, ফজু চাচা, আমিনুল, চাচি, জিয়া চরিত্রগুলো ছোটো হলেও উপন্যাসের ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এরই মধ্যে নাদিরা গর্ভবতী হয়। নির্মলের চাপে সে মোট ২০ দিনের ছুটি নিয়ে তার গর্ভের বাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলে। এরপর আরও সাতদিনের ছুটি নিয়ে নিজের বাড়ি যায়। তার বাবা তখন মাইল স্ট্রোক করে হাসপাতালে।

নির্মল ও নাদিরার সম্পর্কে প্রথম ফাটল ধরায় সিনিয়র বস আমিনুল। বস আমিনুলের মাধ্যমে চাচির দোকানে খেতে খেতে নাদিরার প্রমোশনের ব্যাপারে দুঃসংবাদ শোনে। জিয়া স্যারের সঙ্গে নাকি তার অবৈধ সম্পর্ক। আর এ কারণেই নাকি নাদিরার প্রমোশন হয়েছে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে নির্মল।

সহসাই যশোর বদলি হয় নির্মল। এরপর তিনমাসের মধ্যে রৌমারি উপজেলায় চলে যায়। দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ নেই। রফিকের মাধ্যমে নাদিরাও রৌমারিতে নতুন চাকরি নেয়; কেবল নির্মলের সঙ্গ পাবার জন্য। সে সিনিয়র বিলকিস আপার কাছে সকল ঘটনা খুলে বলে। সহকর্মী আজিমও তাকে আশ^াস দেয়। চরাঞ্চলে কাজ করা খুবই কষ্টকর।

নির্মলকে পাওয়ার জন্য রংপুরে এক কবিরাজের কাছে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় সুন্দরী যুবতী পূর্ণিমাকে। আশেক কবিরাজ। ভÐ। দশ হাজার টাকা দাবি করে। নাদিরা বোরকা পরে যায়। নাদিরার সুগঠিত শরীর দেখে কবিরাজ তাকে রাতে থাকতে বলে। তারা ভয় পেয়ে যায়। আবার বলে নাদিরাকে একা থাকতে হবে। এতে নাদিরা রাজি হয়নি। ভÐামি বুঝতে পেরে নাদিরা টাকা ফেরত চায়। তখন আশেক কবিরাজ নরম হয়। কৌশল করে বলে টাকা তো ফেরত দেওয়া যাবে না। আরও কিছু বুজরকি কথা বলে নাদিরাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে। সে ঘরে শেষপর্যন্ত পূর্ণিমা ও নাদিরা ভয়ে ভয়ে রাত কাটায়। এ উপন্যাসে পিরের উপস্থিতি না থাকলেও বিশেষ ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না। তবু এ পিরবাদের স্বরূপ উন্মোচনই হয়ত ঔপন্যাসিকের মূল লক্ষ্য হবে।

দাম্পত্য সমস্যা মীমাংসা করে দিবে বলে দশ হাজার টাকা চেয়েছিল বিলকিস আপা এবং করেও দিলেন। মাস্তান প্রকৃতির কিছু লোক বাসার আশেপাশে রেখে নির্মলের সঙ্গে দুইলক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য করে পুনরায় বিয়ে পড়ানো হয়। কিন্ত এ বিয়ে শেষপর্যন্ত টিকলো না।

কিছুদিন ভালো গেলেও নির্মলের মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। নাদিরার প্রমোশনটা হয়ত যোগ্যতা দিয়ে পায়নি। এই সন্দেহ থেকেই নির্মলের দূরে সরে যাওয়া। তারপর একদিন উধাও। ঘটনাটি এখানেই মিটে যেতে পারত। কিন্তু মিটেনি। নাদিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। খুঁজে বেড়ায় নির্মলকে। একসময় পেয়েও যায় যমুনার তীরে। তাকে আবার আঁচলে বাঁধতে চায়, এবার অনেককে জানিয়ে। তারপরও সে ব্যর্থ হয়। নির্মল আবার উধাও হয়ে যায়। দুজন থাকে যমুনার দুই তীরে।

তাদের সম্পর্ক কিছুটা আঁচ করতে পেরে দুজনকেই দুই জায়গায় বদলি করা হয়। নাদিরাকে বদলি করা হয়েছে সৈয়দপুরে। নির্মল অনেকটা জোর করেই বিদায় নিলো। রৌমারি বালিচরের প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ুর মতো তার জীবনে এখন দুর্বিসহ ঘূর্ণিঝড়। আলো-আঁধারে ছেয়ে গেছে তার চোখ-মুখ। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল ঘূর্ণিবায়ু আর সে বায়ুতে উড়ে যায় তার বিয়ের ধূসর কাবিন। তবু আশা জমা থাকে হুদয়ের গোপন দহলিজে। ঔপন্যাসিকের ভাষায়Ñব্রহ্মপুত্রের দুকূল ভাঙতে ভাঙতে কোনোদিন যদি এককূল হয়, তাহলে হয়তো নাদিরা আর নির্মলÑআবার একজন অন্যজনের দেখা পাবে।

ঔপন্যাসিকের সবচেয়ে বড়ো দক্ষতা হলো চরিত্র অনুযায়ী সংলাপের সুনিপুণ ব্যবহার। অবস্থাভেদে সে সংলাপও বেশ গুরুত্ব বহন করে। একটি উপন্যাসের পটভূমি ক্ষুদ্র কোনো স্থানকে কেন্দ্র করে হলেও ঔপন্যাসিকের শিল্পছোঁয়ায় তা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক। প্রয়োজনমাফিক চরিত্রচিত্রণ তাঁর একটি বড়ো গুণ। ভাব ও ঘটনার পরম্পরা রক্ষা করা সবচেয়ে বড়ো দুঃসাধ্য কাজ

চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে বাস্তব ও রোমান্টিকজগতের জটিল থেকে জটিলতর দিকগুলোকেই তিনি অবলীলায় উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর লেখার প্লট, ভাব, ভাষা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সন্নিবেশ, পরম্পরা, কাহিনির গভীরতা, সময়ের ঐক্য, ব্যাপ্তি, সমাপ্তি সবকিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অনন্য। ভাষার সরলতা ও কাহিনির গতিশীলতা পাঠকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *