⭐ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কত বড়ো?
মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে এক গভীর প্রশ্ন ছুড়ে এসেছে—এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আসলে কত বড়? এই প্রশ্নের উত্তর আজও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি; জানা সম্ভবও নয়। কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এতটাই বিশাল, এর বিস্তার এতটাই অসীমের দিকে ধাবিত যে মানুষের পর্যবেক্ষণ-সামর্থ্য ও প্রযুক্তি এখনো তার সম্পূর্ণ পরিধি ধরতে সক্ষম নয়। তবুও আধুনিক মহাজাগতিক বিজ্ঞান, দূরবীক্ষণ প্রযুক্তি এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার সাহায্যে আমরা একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ধারণা পেয়েছি—বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কতটা বিশাল হতে পারে।
🌌 ১. বিশ্বব্রহ্মাণ্ড: অসীম না সসীম?
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন ব্রহ্মাণ্ডের আকার সত্যিই অসীম কি না। দুটি ধারণা প্রচলিত:
- ব্রহ্মাণ্ড অসীম — এটি সীমাহীনভাবে বিস্তৃত, এর কোনো শেষ নেই।
- ব্রহ্মাণ্ড সসীম কিন্তু সীমাবদ্ধ — অর্থাৎ এর আকার আছে, কিন্তু কোনো স্পষ্ট সীমান্ত নেই; যেমন গোলকের পৃষ্ঠের মতো, ঘুরে ফিরে একই স্থানে আসা যায়।
কিন্তু আমরা যা জানি তা হলো—ব্রহ্মাণ্ড ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিগ ব্যাং-এর পর থেকে এই সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে, যা একে আরও বিশাল করে তুলছে।
🌠 ২. দৃশ্যমান বা “Observable Universe”
ব্রহ্মাণ্ডের পুরোটা আমরা দেখতে পাই না। আমরা দেখতে পাই শুধু সেই অংশ যেখান থেকে আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। এটিই observable universe—দৃশ্যমান মহাবিশ্ব।
● দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস:
প্রায় ৯৩ বিলিয়ন (৯৩০০ কোটি) আলোকবর্ষ।
এর অর্থ হলো—
আমরা যে দূরত্ব পর্যন্ত মহাবিশ্ব দেখতে পাই, সেই সীমা পৃথিবী থেকে দুইদিকে প্রায় ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে।
অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো—মহাবিশ্বের বয়স মাত্র ১৩.৮ বিলিয়ন বছর, তবে আলোক-গমনগত গতির সীমাবদ্ধতা ও স্থান-কালের প্রসারণের ফলে দৃশ্যমান এলাকার ব্যাস এর চেয়েও অনেক বেশি।
🚀 ৩. আলোকবর্ষ ও দূরত্ব বোঝা
মহাবিশ্বের পরিমাপে “কিলোমিটার” বা “মাইল” খুব ছোট একক। এজন্য ব্যবহৃত হয়—
- ১ আলোকবর্ষ = আলোর ১ বছরে অতিক্রান্ত পথ
- এর মান প্রায় ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার
এভাবে দূরত্ব বোঝা যায়:
- নিকটতম তারকা Proxima Centauri—৪.২৪ আলোকবর্ষ দূরে
- মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যাস—প্রায় ১ লক্ষ আলোকবর্ষ
- দৃশ্যমান মহাবিশ্ব—৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ
এই তুলনা থেকেই বোঝা যায়, আমাদের ছায়াপথ মহাবিশ্বের তুলনায় একেবারে বালুকণার মতো।
🌌 ৪. মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও “Dark Energy”
১৯৯০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে মহাবিশ্ব শুধু সম্প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং সম্প্রসারণের গতি ক্রমাগত বাড়ছে।
এই অদৃশ্য শক্তিকে বলা হয়—
👉 ডার্ক এনার্জি (Dark Energy)
- এটি মহাবিশ্বের মোট শক্তির প্রায় ৬৮%
- এর প্রকৃতি পুরোপুরি জানা যায়নি
- ধারণা করা হয় এটি স্থান নিজেই তৈরি করে
- যার ফলে মহাবিশ্বের বিস্তার অবিরাম দ্রুততর হচ্ছে
ডার্ক এনার্জি থাকায় মহাবিশ্বের আকার মাপা আরও কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ ভবিষ্যতে এর আকার কেমন হবে তা অনুমান করা কঠিন।
🌌 ৫. আমাদের গ্যালাক্সির তুলনায় মহাবিশ্ব
একটি সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না মহাবিশ্ব কত বিশাল।
- আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে-তে তারার সংখ্যা
→ ২০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন - দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ছায়াপথের সংখ্যা
→ ২ ট্রিলিয়নেরও বেশি
যদি ধরে নেওয়া হয় প্রতিটি ছায়াপথে মিল্কিওয়ের মতো গড়পড়তা তারকা রয়েছে, তাহলে—
দৃশ্যমান মহাবিশ্বে তারকার সংখ্যা
৭০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ (সেভেন্টি সেক্সটিলিয়ন)-এর বেশি।
এমন বিশালত্ব মানুষের মস্তিষ্কে ধারণা করা অবিশ্বাস্য।
🪐 ৬. দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরে কী আছে?
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন—
- দৃশ্যমান মহাবিশ্ব পুরো মহাবিশ্বের মাত্র ৪% বা তারও কম।
- বাকিটা আমাদের পর্যবেক্ষণের বাইরে কারণ আলো এখনো সেখানে থেকে আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
- মহাবিশ্ব হয়তো অগণিত গ্যালাক্সি, অগণিত অঞ্চল, এবং সম্ভবত বহু মাত্রা (multiverse) ধারণ করে আছে।
একাধিক বৈজ্ঞানিক মডেল রয়েছে—
➤ ইনফ্লেশন মডেল
বিগ ব্যাং-এর পর অল্প সময়ের মধ্যেই মহাবিশ্ব প্রচণ্ড গতিতে বিস্তৃত হয়—যেটি এখনও প্রমাণসমর্থিত।
➤ মাল্টিভার্স তত্ত্ব
সম্ভবত আমাদের মহাবিশ্ব অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি মাত্র “বুদবুদ”।
যদিও এগুলো প্রমাণিত নয়—তবে সম্ভাবনা বিজ্ঞানীদের কল্পনাকে বিস্তৃত করেছে।
🛰️ ৭. মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ (CMB)
১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত Cosmic Microwave Background Radiation হলো বিগ ব্যাং-এর অবশিষ্ট তাপ।
- এটি মহাবিশ্বের আকার, বয়স ও গঠন জানতে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র।
- CMB বিশ্লেষণ থেকে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের আকার (৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ) নির্ধারিত হয়।
এটি মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন আলোর উৎস, যা প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর ধরে আমাদের দিকে আসছে।
⭐ ৮. তাহলে মহাবিশ্ব কত বড়?
সংক্ষেপে বৈজ্ঞানিক ধারণা:
- দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস → ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ
- পুরো মহাবিশ্ব → দৃশ্যমান অংশের বহু গুণ বড় (অপরিমেয়)
- মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত → ভবিষ্যতে আরও বিশাল হবে
- মহাবিশ্বের সঠিক আকার জানা সম্ভব নয়
কারণ আমরা দেখতে পাই কেবল সেই অঞ্চল যেখান থেকে আলো এসেছে।
বিজ্ঞানীদের মতে—
মহাবিশ্ব হয়তো অসীম, আর যদি সসীমও হয় তবে এত বড় যে কোনো প্রযুক্তি কখনোই তার পুরো অংশ দেখতে পারবে না।
