খোকার সাধ

কাজী নজরুল ইসলাম
ধরন: কবিতা
আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসম-বাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূয্যি মামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’–মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো,
হয়নি সকাল–তাই বলে কি সকাল হবে নাকো!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠবো পাহাড়-চূড়ে,
দেখবো নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে,
ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়,
বলবো আমি, ‘ভোর হলো যে, সাগর ছুটে আয়!’
ঝর্ণা-মাসি বলবে হাসি, ‘খোকন এলি নাকি?’
বলবো আমি, ‘নইকো খোকন, ঘুম-জাগানো পাখি!’
ফুলের বনে ফুল ফোটাবো, অন্ধকারে আলো,
সূয্যিমামা বলবে উঠে, ‘খোকন, ছিলে ভালো?’
বলবো, ‘মামা, কথা কওয়ার নাইকো সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙো ঘুমের দ্বার।’
রবির আগে চলবো আমি ঘুম-ভাঙা গান গেয়ে,
জাগবে সাগর, পাহাড় নদী, ঘুমের ছেলে-মেয়ে!
কবিতার ব্যাখ্যা: “খোকার সাধ” — কাজী নজরুল ইসলাম
এই কবিতায় কবি একটি শিশুর কল্পনার জগৎ ও তার প্রাণবন্ত, উৎসাহী স্বপ্নকে তুলে ধরেছেন। শিশুটি সকালে সবার আগে জেগে উঠতে চায়। সে চায় এমন একটি পাখি হতে, যে ভোর হবার আগেই কুসুমবাগে গিয়ে ডাক দিয়ে সবার ঘুম ভাঙাবে।
কবিতায় শিশুটির স্বপ্ন, সাহস, ও কর্মপ্রবণতা ফুটে উঠেছে। সে চায় সূর্যোদয়ের আগেই জেগে উঠে শহর, সাগর, পাহাড়, নদী—সবকিছুকে জাগাতে। মায়ের ‘ঘুমাও’ বলা তার কাছে আলস্যের প্রতীক। সে মাকে বোঝাতে চায়—ঘুমিয়ে থাকলে সকাল আসবে না, বরং সকালের আগমন ঘটাতে সক্রিয় হতে হবে। সে ভাবে, তার জেগে ওঠার মাধ্যমেই প্রকৃতি ও জগৎ জেগে উঠবে।
এই কবিতার মাধ্যমে নজরুল শিশুর কণ্ঠে ভবিষ্যতের বার্তা দিয়েছেন। শিশুর কল্পনার ভেতরে লুকিয়ে আছে জাগরণ, আলোর আহ্বান এবং সক্রিয়তার বার্তা। এটি একটি অনুপ্রেরণামূলক কবিতা, যা শিশুর মধ্যে সচেতনতা, দায়িত্ববোধ ও আশাবাদের বীজ বপন করে।
ছন্দ বিশ্লেষণ:
এই কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। এতে প্রতি পংক্তিতে নির্দিষ্ট মাত্রা অনুসরণ করা হয়েছে। নজরুলের এই ছন্দ ব্যবহার ছন্দে সুরের ছন্দময়তা এনে দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, প্রথম কয়েকটি পঙক্তি বিশ্লেষণ করা যাক:
🔹 আমি হবো সকাল বেলার পাখি
👉 ১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত (৭+৭ ভাগে বিভক্ত)
(আ-মি হো-বো / স-কা-ল বে-লা-র / পা-খি)
🔹 সবার আগে কুসম-বাগে উঠবো আমি ডাকি।
👉 ১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত (৭+৭)
(স-বা-র আ-গে / কু-সু-ম বা-গে / উ-ঠো আ-মি ডা-কিঃ)
এই রকম ভাবে পুরো কবিতায় সুনির্দিষ্ট মাত্রা ও ছন্দ বজায় রাখা হয়েছে, যা কবিতাটিকে পাঠযোগ্য, শ্রুতিমধুর এবং আবেগময় করে তোলে।