মোহাম্মদ লুৎফর রহমান: সমাজসেবী ও সাহিত্যিক

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান: সমাজসেবী ও সাহিত্যিক

মোহাম্মদ_লুৎফর_রহমান
মোহাম্মদ_লুৎফর_রহমান

 

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান: সমাজসেবী ও সাহিত্যিক

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান (১৮৮৯–১৯৩৬) ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক, সম্পাদক ও সমাজকর্মী। তিনি মানবিক মূল্যবোধ ও সমাজসচেতনতা নিয়ে তাঁর রচনায় নিবেদিত ছিলেন। নারীর উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক কল্যাণ তাঁর সাহিত্য ও কর্মজীবনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল। সাধারণভাবে তিনি ‘ডাক্তার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান’ নামে পরিচিত।


প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ সালে মাগুরা মহাকুমার পরনান্দুয়ালী গ্রামে। পিতা মইনউদ্দিন আহমদ, মাতা শামসুন নাহার। তিনি পাঁচ সন্তানসম্ভূক্ত দম্পতির মধ্যে একজন। পিতার ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লুৎফর রহমানের মধ্যে সাহিত্যের আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল।

প্রাথমিক শিক্ষা তিনি নিজ গ্রাম হাজিপুরের নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সম্পন্ন করেন। এরপর মাগুরা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯১৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার হুগলী মহসিন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেননি। ১৯২১ সালে কৃষ্ণনগর হোমিওপ্যাথিক কলেজ থেকে এইচএম-বি ডিগ্রি লাভ করেন।


কর্মজীবন

লুৎফর রহমান শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯১৬ সালে সিরাজগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলে অ্যাংলো-পারসিয়ান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৮ সালে তিনি চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ হাই স্কুলে একই পদে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে কলকাতায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন।

পরবর্তীতে তিনি মাগুরার পান্নান্দুয়ালি গ্রামের বাড়িতে ডাক্তারখানা খুলে সমাজসেবায় মনোনিবেশ করেন। নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে নারীদের সামাজিক ও শিক্ষামূলক উন্নয়নে অবদান রাখেন। পাশাপাশি তিনি নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সমাজচেতনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন।


সাহিত্যিক অবদান

লুৎফর রহমান ছিলেন মুক্তবুদ্ধির অধিকারী, যার প্রভাব তাঁর সাহিত্যচর্চায় ফুটে উঠেছে। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন।

কাব্যগ্রন্থ

  • প্রকাশ (১৯১৬)

প্রবন্ধ

  • উচ্চ জীবন (১৯১৯)
  • মহৎ জীবন (১৯২৬)
  • উন্নত জীবন (১৯২৭)
  • মানবজীবন (১৯২৭)
  • সত্য জীবন (১৯৪০)
  • ধর্ম জীবন (১৯৭১)
  • মহাজীবন (১৯৭৫)
  • যুবকজীবন (১৯৮৫)

উপন্যাস

  • সরলা (১৯১৮)
  • পথহারা (১৯১৯)
  • রায়হান (১৯১৯)
  • প্রীতি-উপহার (১৯২৭)
  • বাসর-উপহার (১৯৩৬)

ছোটগল্প

  • পলায়ন
  • রাণী
  • অহিংসা
  • রাজপথ
  • অমাবস্যা
  • রোমান্টিক বিয়ে
  • ফিরে যাও-ফিরে যাও

শিশুতোষ সাহিত্য

  • ছেলেদের মহত্ত্বকথা (১৯২৮)
  • ছেলেদের কারবালা (১৯৩১)
  • রাণী হেলেন (১৯৩৪)

অনুবাদ

  • মঙ্গল ভবিষ্যৎ
  • দুঃখের রাত্রি (ভিক্টোর হুগোর লা মিজারেবল এর অনুবাদ)
  • মুসলমান

লুৎফর রহমানের সাহিত্য সরল, ভাবগম্ভীর এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি নিবেদিত। তিনি বিশেষত নারী সমাজের উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণে মনোনিবেশ করতেন।


চিন্তাধারা ও আদর্শ

লুৎফর রহমান বিশ্বাস করতেন, মানুষের শক্তির প্রধান উৎস জ্ঞান এবং জীবনের সেরা অনুভূতি হচ্ছে প্রেম। তিনি লোকদেখানো বা বংশগত সম্মানকে কখনো মূল্যায়ন করেননি। মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন ও সত্য জীবন তাঁর সাহিত্য ও কর্মজীবনের মূল মন্ত্র।


মৃত্যু

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ, ৪৭ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে তাঁর নিজ গ্রাম হাজিপুরে সমাহিত করা হয়।


উপসংহার

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান কেবল একজন সাহিত্যিক ছিলেন না; তিনি সমাজসেবী, মুক্তচিন্তক ও নারীর অধিকারকামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি বাংলা সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, শিক্ষা ও উন্নত চিন্তাচেতনার সংমিশ্রণ রেখেছেন।


https://www.munshiacademy.com/মোহাম্মদ-লুৎফর-রহমান-সমা/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *